পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৭০
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

কামানও গর্জন করিয়া উঠিল। মোরানের সৈন্যগণ সেই কামানের ধূমে আচ্ছন্ন হইয়া, নদীর সন্নিহিত প্রবেশপথের নিকট ইংরেজদিগের কৃত ভগ্নাংশের নিকট উপস্থিত হইল; পরে অনেক কষ্টে পরিখা পার হইয়া প্রাচীরের উপর উঠিয়া দাঁড়াইল।

 যদি মীর কাসেমের সৈন্যেরা সামান্যমাত্রও সতর্কতা অবলম্বন করিত, তাহা হইলে মোরান কদাচ পরিখা পার হইয়া প্রাচীরে উঠিতে পারিতেন না। মোরানের সৈন্যরা পীরপাহাড় হইতে অবতীর্ণ আর্ভিং-এর সৈন্যের সহিত করমর্দন করিয়া, নবাবশিবিরধ্বংসে প্রবৃত্ত হইল। নৈশ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া ইংরেজ-কামানধ্বনি উধূয়ার পর্বতশ্রেণীকে বিকম্পিত করিয়া তুলিল; গঙ্গাসলিলরাশি আন্দোলিত হইয়া তীরে আঘাত করিতে লাগিল। রজনীর অন্ধকার ভেদ করিয়া, মেঘবক্ষ সৌদামিনীর ন্যায় কামান ও বন্দুক হইতে অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল; নবাবসৈন্যগণ যুদ্ধার্থ সজ্জিত হইবার অবকাশ পর্যন্ত পাইল না; তাহাদের কিয়ৎসংখ্যক সৈন্য উধূয়ানালার পরপারে সেতুর নিকট দণ্ডায়মান হইয়া, ক্রমাগত ইংরেজাধিকৃত আপনাদিগের শিবির লক্ষ্য করিয়া গোলাবৃষ্টি করিতেছিল। যে উধূয়া পার হওয়ার চেষ্টা করিল, সে অমনি নালাগর্ভে নিমজ্জিত হইল। নবাব-সৈন্যগণ যতক্ষণ পারিল, ইংরেজ-সৈন্যের সহিত যুদ্ধে একে একে প্রাণ বিসর্জন দিল। এই আক্রমণে নবাবপক্ষের প্রায় ১৫ হাজার সৈন্য বিনষ্ট হয়; তাহাদের অনেকগুলি কামানও ইংরেজেরা হস্তগত করেন। ৫ই সেপ্টেম্বর প্রাতঃকালে সাতটার সময় সমস্ত শিবির ইংরেজদিগের অধিকৃত হইয়া যায়। সমরু ও মার্কারের সৈন্যেরা ইংরেজদিগকে বাধা দিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারে নাই। তাঁহারা অবশেষে উধূয়া পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হয়। ইংরেজেরা উধূয়া হইতে রাজমহলে উপস্থিত হইয়া, পরে মুঙ্গের অভিমুখে যাত্রা করেন। মীর কাসেম ইতিপূর্বে মুঙ্গের পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহার মুঙ্গের পরিত্যাগের পূর্বে জগৎশেঠ-প্রভৃতি সন্ত্রান্ত ব্যক্তিদিগকে গঙ্গাজলে নিমজ্জিত করিয়া বধ করা হয়। মীর কাসেম পলায়ন করিয়া প্রথমে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার শরণাপন্ন হন; সুজা উদ্দৌলা পরে মীর কাসেমের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ায়, মীর কাসেম তাহার আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া, বঙ্গরাজ্যের পুনরধিকারের আশা বিসর্জন দিয়া, রোহিলখণ্ড অভিমুখে পলায়ন করেন।

 এইরূপে উধূয়ানালায় মীর কাসেমের সমস্ত সৈন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পলাশী ও উধূয়ানালা এই দুই স্থানে বাঙ্গলার মুসলমান-গৌরব চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত হয়। দুঃখের বিষয়, এই দুই স্থানেই বিশ্বাসঘাতকতা ও চাতুরীর সাহায্যে ইংরেজেরা জয় লাভ করিয়াছিলেন। পলাশী অপেক্ষা উধূয়ানালা আক্রমণে ইংরেজদিগের সাহসের কিঞ্চিৎ প্রশংসা করা যাইতে পারে; কিন্তু সে সাহসপ্রদর্শনের মূল নবাবসৈন্যের অসতর্কতা। ইংরেজেরা যেরূপ অসমসাহসিকতা অবলম্বন করিয়া উধূয়ানালার শিবির আক্রমণ করিয়াছিলেন, যদি নবাবসৈন্যের একজনমাত্রও সতর্ক থাকিত, তাহা হইলে, তাহাদিগকে উধূয়াপর্বতপ্রান্তস্থিত ঝিলজলে চিরদিনের জন্য নিমজ্জিত হইয়া থাকিতে