পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৭৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

মুর্শিদাবাদ-কাশী শ্রীহীন ও অরণ্যসম হইলেও আজিও এমন এক পবিত্রতার ধারা ঢালিয়া দেয় যে, তাহাতে সমস্ত অন্তরাত্মা আপ্লুত হইয়া যায়। বৃহৎ বৃহৎ অশ্বখ বট প্রভৃতি বৃক্ষাদি দূরব্যাপী শাখাবিস্তারপূর্বক অর্থভাগীরথীকে ছায়াময়ী করিয়া, বড়নগরকে যেন তপোবনতুল্য করিয়া রাখিয়াছে। যাঁহারা শান্তিপ্রয়াসী, তাঁহারা এই শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হইলে, অনায়াসেই মহাশান্তি লাভ করিতে পারিবেন।

 বড়নগর ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে এবং বর্তমান আজিমগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন হইতে প্রায় অর্ধক্রোশ উত্তরে অবস্থিত। বড়নগর পূর্বে সুবিস্তৃত রাজশাহী জমিদারীর রাজধানী ছিল। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর দিন পর্যন্ত বড়নগর মুর্শিদাবাদের একটি প্রধান বাণিজ্যস্থান ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে যে-সমস্ত প্রধান প্রধান আড়ঙ্গ ছিল, বড়নগর তাহাদের মধ্যে অন্যতম।[১] এই সমস্ত আড়ঙ্গে ইউরোপীয়গণের দালাল-গোমস্তারা প্রতিনিয়তই গতায়াত করিত। বড়নগরের পিত্তল, কাঁসার দ্রব্য অতীব উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। বড়নগরের ঘড়ার কথা বঙ্গবাসীমাত্রেই বিশেষ করিয়া জানিত। এখানে এত অধিক কাংস্যবণিকের বাস ছিল যে, রজনীর শেষভাগে তাহাদিগের বাসন-নির্মাণের শব্দে সমস্ত গ্রামের লোকের নিদ্রাভঙ্গ হইত। এজন্য রাজা বিশ্বনাথের মহিষী রানী জয়মণি বলিয়াছিলেন যে, তাহার আর নহবত রাখিবার প্রয়োজন হইবে না। মুর্শিদাবাদের খাগড়া প্রভৃতি স্থানের অধিকাংশ কাংস্যবণিকের বাসস্থান পূর্বে বড়নগরেই ছিল। রেনেলের কাশিমবাজার দ্বীপের মানচিত্রে বড়নগরের প্রাধান্য প্রতিপাদনের জন্য তাহার নাম বৃহদক্ষরে লিখিত হইয়াছে। বড়নগর তৎকালীন মুর্শিদাবাদের একরূপ প্রান্তদেশে অবস্থিত ছিল; অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদাবাদ প্রায় বড়নগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজা উদয়নারায়ণের ধ্বংসের পর রাজশাহী জমিদারী নাটোর রাজবংশের করায়ত্ত হইলে, বড়নগর তাহাদের মুর্শিদাবাদের বাসস্থানরূপে নিদিষ্ট হয়; রাজধানী মুর্শিদাবাদে তৎকালে বঙ্গের প্রায় সমস্ত জমিদারদিগেরই এক-একটি বাসস্থান ছিল। বিশেষতঃ নাটোররাজবংশের আদিপুরুষ রঘুনন্দন মুর্শিদাবাদে নায়েব-কাননগোর কার্য করিতেন বলিয়া, তাহাকে মুর্শিদাবাদেই থাকিতে হইত। রঘুনন্দন প্রথমতঃ পুঁটিয়া রাজসংসারে সামান্য কর্মে নিযুক্ত হন; পরে পুঁটিয়ার রাজা দর্পনারায়ণ তাহাকে পুঁটিয়ার উকীল নিযুক্ত করিয়া, প্রথমে ঢাকায় নবাবদরবারে পাঠাইয়া দেন। তথা হইতে তিনি মুর্শিদকুলি খাঁর সহিত মুর্শিদাবাদে আগমন করেন। রঘুনন্দন স্বীয় বুদ্ধিমত্তায় কমে নায়েব-কাননগোর পদ প্রাপ্ত হন এবং মুশিদকুলি খাঁর প্রিয়পাত্র হইয়া, তাহার অনুগ্রহে অনেক জমিদারী লাভ করেন। এই সমস্ত জমিদারী তাহার ভ্রাতা রামজীবনের নামে গৃহীত হইয়াছিল। রামজীবনের পুত্র কুমার কালিকাপ্রসাদ রামকান্তকে দত্তকপুত্র গ্রহণ করেন এবং তাহার জনককে চৌগ্রাম ও ইসলামাবাদ নামে দুই পরগণার জমিদারী প্রদান করেন। রামজীবনের

  1. Long's Selection, p. 63.