পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৪
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

বিবেচনা করিলেন। গোলাম মহম্মদ তাঁহার দোলায়মান চিত্তকে উত্তেজিত করিবার জন্য নানা প্রকার উৎসাহবাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। মুর্শিদকুলীর অন্যায় ব্যবহার ও জমিদারগণের প্রতি অত্যাচারের কথা স্মরণ করাইয়া, গোলাম মহম্মদ রাজাকে সমরক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিল। রাজার অন্যতম সৈন্যাধ্যক্ষ কালিয়া জমাদারও নিতান্ত নীরব ছিল না। রাজা উভয় সৈন্যাধক্ষের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হওয়ায়, নবাবের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিলেন। বিশেষতঃ নবাব রাজাকে সৈন্যগণের অত্যাচার নিবারণ করিতে অনুরোধ না করিয়া, কিংবা সে বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা না করিয়া, যখন একেবারে তাহার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিয়াছেন, তখন তিনি নবাবের গূঢ় উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার যে-যশোগরিমা দিন দিন পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছিল, নবাব তাহারই ধ্বংসের জন্য ব্যগ্র হইয়াছেন। এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া তিনি গোলাম মহম্মদের কথায় সম্মত হইলেন। হিন্দু জমিদারগণের প্রতি অযথা অত্যাচারের স্মৃতিও তাঁহার হৃদয়মধ্যে এক ঘোর বিপ্লব উপস্থিত করিল। তিনি তাহাতে উত্তেজিত হইয়া, অদম্য ভাগীরথী প্রবাহের ন্যায় নবাবসৈন্যের সমক্ষে সামান্য শৈলবৎ দণ্ডায়মান হইলেন। কিন্তু সেই স্রোতে তাঁহাকে চিরদিনের জন্য ভাসিয়া যাইতে হইয়াছিল। উভয় সেনাপতির সহিত পরামর্শের অল্প কাল পরে উদয়নারায়ণ বড়নগর পরিত্যাগ করিয়া সুলতানাবাদের অন্তর্গত বীরকিটি-নামক স্থানে তাঁহার সুরক্ষিত বাসভবনে বাস ও তাহার নিকটবর্তী জগন্নাথপুরের গড়ে সৈন্য স্থাপন করেন। বীরকিটি এক্ষণে বর্তমান সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত।

 ক্ষিতীশবংশাবলিচরিতে উদয়নারায়ণের সহিত যুদ্ধ-সম্বন্ধে যাহা লিখিত আছে, এস্থলে তাহারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হইতেছে। উক্ত পুস্তকে উদয়নারায়ণ, গোলাম মহম্মদ ও মহম্মদ জানের পরিবর্তে, উদয়চাঁদ, আলি মহম্মদ ও লহরীমাল লিখিত হইয়াছে।[১] নবাব সেনাপতি লহরীমাল সসৈন্যে বীরকিটি[২] গ্রামের নিকটস্থ হইলে, মহম্মদও তথায় শিবির সন্নিবেশ করে। আলি মহম্মদের সৈন্যগণের উৎসাহ ও অধ্যবসায় দেখিয়া লহরীমাল অত্যন্ত চিন্তান্বিত হইলেন। তিনি উদয়চাঁদ ও আলি মহম্মদ উভয়কেই উত্তমরূপে জানিতেন; উভয়ে সমরক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলে, তাঁহার পক্ষে যে বিষম অনর্থ উপস্থিত হইবে, ইহা তিনি বিলক্ষণ রূপে বুঝিতে পারলেন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। এই সময়ে নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা রঘুরাম লহরীমালের সহিত উদয়চাঁদের বিরুদ্ধে রাজশাহী যাত্রা করিয়াছিলেন। রঘুরামের পিতা রাজা রামজীবন রাজস্বপ্রদানে অসমর্থ হওয়ায় বন্দী হইয়া মুর্শিদাবাদে অবস্থিতি করিতেছিলেন; পুত্র রঘুরামও তাঁহার সমভিব্যাহারে

  1. প্রচলিত ইতিহাসে যে সমস্ত নাম দৃষ্ট হয়, আমরা তাহাই গ্রহণ করিয়াছি।
  2. এই বীরকিটি ক্ষিতীশবংশাবলিতে বারকাটি বলিয়া লিখিত আছে।