পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
কান্তবাবু
৩০৩

প্রচলিত আছে, আমরা দুই একটির উল্লেখ করিতেছি। কান্তবাবু যখন কাশীমবাজার ইংরেজ কুঠীতে মুহুরীর পদে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় হইতে একজন কলু তাঁহার বাটীর নিকট বাস করিত। কান্তবাবুকে প্রতিদিনই তাঁহার মুখ দর্শন করিয়া কার্যস্থানে যাইতে হইত। কিন্তু প্রচলিত প্রবাদানুসারে তাঁহার কার্যে কোনরূপ বিঘ্ন না ঘটিয়া বরং উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ হয়। যৎকালে তিনি বিশাল সম্পত্তির অধিপতি হইয়া কাশীমবাজারে স্বীয় বাসভবন নূতনরূপে নির্মাণ করাইয়া চতুর্দিক হইতে সম্মান ও গৌরব লাভ করিতেছিলেন, সে সময়েও উক্ত কলু তাঁহার বাটীর নিকটেই বাস করিবার অধিকার পায়। কান্তবাবু তাঁহাকে নির্ভয়ে বাস করিতে অনুমতি প্রদান করেন। একদিন তাঁহার কোনও আত্মীয় তাঁহাকে বলেন যে, আপনার প্রাসাদের নিকট একজন ইতরজাতি বাস করিবে, ইহা কদাচ সঙ্গত নহে। অতএব যাহাতে উক্ত কলু স্থানান্তরিত হয়, তজ্জন্য আপনার যত্ন করা উচিত। কান্তবাবু উত্তর করিলেন যে, তিনি প্রতিদিন উহার মুখ দেখিয়া কার্যস্থানে গমন করিতেন, তাহাতে তাঁহার উন্নতি ব্যতীত কদাচ অবনতি ঘটে নাই। এখন তাঁহার এক প্রকার উন্নতির চরমসীমা হইয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না। তিনি যদি এক্ষণে ঐ দরিদ্রকে তাঁহার বাসস্থান হইতে বিদূরিত করিয়া দেন, তাহা হইলে তাঁহাকে পাপের ভাগী হইতে হইবে। তিনি যতদিন জীবিত থাকিবেন, ততদিন উহাকে রক্ষা করিবেন। কান্তবাবু উক্ত কলুকে বিশেষরূপ সাহায্য করিতেন। এইরূপ অনেক গল্প তাঁহার জীবনের সহিত জড়িত রহিয়াছে।

 কান্তবাবু একবার তীর্থপর্যটনে বহির্গত হন। ক্রমে ক্রমে জগন্নাথক্ষেত্র পুরীধামে উপস্থিত হইয়া অন্নসত্র খুলিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটি বিষম গোলযোগ উপস্থিত হয়। পাণ্ডারা প্রথমে বঙ্গদেশ হইতে একজন ধনী আসিয়াছেন জানিয়া, কান্তবাবুকে দোহন করিবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি অন্নসত্র খুলিবার প্রস্তাব করিলে, তাঁহারা কোনরূপে অবগত হইলেন যে, কান্তবাবু জাতিতে তেলি। তৈলকারের নিকট হইতে দানগ্রহণে পাণ্ডারা স্বীকৃত হইলেন না। কান্তবাবু অত্যন্ত বিপদে পড়িলেন। তিনি বাস্তবিক তৈলকার নহেন। অথচ পাণ্ডাগণের এ ভ্রম দূর করাও সহজ নহে। তীর্থক্ষেত্রে আসিয়া যদি কেহ দান গ্রহণ না করে, অথবা নিজ সংকল্প সংসাধিত না হয়, তাহা হইলে হিন্দুহৃদয়ে যে অত্যন্ত আঘাত লাগিয়া থাকে, তাহা বলা বাহুল্যমাত্র। তিনি স্বীয় জাতিত্বের প্রমাণের জন্য নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থান হইতে ব্যবস্থা আনয়নের বন্দোবস্ত করিলেন। পণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দিলেন যে, তাঁহারা বাস্তবিক তৈলকার নহেন, তৈলিক, অর্থাৎ তেলি নহেন, তিলি। তিলিগণ নবশাখশূদ্রের অন্যতম; তাঁহারা সচ্ছুদ্র; তাঁহাদের দানগ্রহণে সেরূপ প্রত্যবার নাই। তখন তাঁহারা স্বীকৃত হইয়া কান্তবাবুর দান গ্রহণ করেন এবং তাঁহার অন্নসত্রেরও সুবন্দোবন্ত করিয়া দেন। তীর্থস্থানে অপদস্থ হওয়ায় কান্তবাবু যে বিচলিত হইয়াছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এই সমস্ত গল্প ও প্রবাদ বিচার করিলে,