পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
২৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

 সুজা উদ্দীন নানাবিধ সদ্‌গুণে সমলঙ্কৃত থাকিলেও তাঁহার কিঞ্চিৎ ইন্দ্রিয়দোষ ছিল। কাহারও কাহারও মতে যে ইন্দ্রিয়দোষের হস্ত হইতে মোগলকুলের আদর্শ সম্রাট্‌ আকবর শাহাও নিস্তার পান নাই, সুজা উদ্দীন যে তাহার দ্বারা আক্রান্ত হইবেন, ইহা বড় বিচিত্র নহে। সুজা মুর্শিদাবাদের মসনদে উপবেশন করিয়া অত্যন্ত বিলাসী হইয়া উঠেন। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর নির্মিত অট্টালিকাদি সুজার বিবেচনায় তাদৃশ মনোরঞ্জক না হওয়ায়, তিনি তৎপরিবর্তে অনেক সুন্দর সুন্দর অট্টালিকাদি নির্মাণ করেন। সর্বাপেক্ষা তাঁহার শ্রেষ্ঠ কীর্তি একটি উদ্যান; এই উদ্যানটির নাম ফর্হাবাগ বা সুখকানন। ফৰ্হাবাগ ডাহাপাড়াতেই অবস্থিত, এবং রোশনীবাগ হইতে কিছু উত্তরে। মুর্শিদকুলীর জনৈক অত্যাচারী কর্মচারী নাজীর আহম্মদ এই উদ্যানের নির্মাণ আরম্ভ করিয়া, তথায় মস্‌জেদাদির গঠন করিতেছিল। নবাব সুজা উদ্দীন তাহার অত্যাচারের প্রতিফলস্বরূপ প্রাণদণ্ডের বিধান করিয়া, পরে নিজে সেই উদ্যানটিকে সুশোভিত করিয়াছিলেন। মস্‌জেদটি সুন্দররূপে নিৰ্মাণ করিয়া তিনি উদ্যানের রমণীয়তা চতুর্গুণ বর্ধিত করেন। ঐ উদ্যানের মধ্যে সুন্দর সুন্দর প্রমোদ-অট্টালিকা নির্মিত হয়। উহাতে নানাজাতীয় বৃক্ষ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া শোভা পাইত। স্থানে স্থানে ফোয়ারা, চৌবাচ্চা ও লহর জলভরে টল টল করিয়া উদ্যানটিকে একখানি ছবির ন্যায় প্রতিপন্ন করিত। ঐ উদ্যানে পুষ্করিণী খনন করিয়া চারিদিকে সোপান দ্বারা সুশোভিত করা হইয়াছিল। নানাবিধ সুগন্ধি পুষ্প প্রস্ফুটিত হইয়া লোকের মনঃপ্রাণ কাড়িয়া লইত। মুসলমান লেখকগণ বলেন যে, ইহার রমণীয়তার নিকট কাশ্মীরের উদ্যানসকল লজ্জা পাইত, এমন কি, স্বর্গের উদ্যানও ইহার নিকট হইতে সৌন্দর্য ঋণ করিয়া লইত। উদ্যানের রমণীয় শোভায় মুগ্ধ হইয়া স্বর্গের পরীগণ ইহাতে ভ্রমণ করিতে আসিত, এবং ইহার চারুসোপানাবলীসমন্বিত পুষ্করিণীর স্ফটিকশুভ্র স্বচ্ছজলে অবগাহন করিয়া, কুসুমগন্ধাপহারী মলয়সমীরে শরীর সুস্নিগ্ধ করিত। নবাব প্রহরীদের নিকট পরীদিগের আগমনের কথা অবগত হইয়া, ধূলিবৃষ্টিদ্বারা উদ্যানের সৌন্দর্য নষ্ট করিয়া তাহাদিগকে স্বৈরবিহার হইতে নিবৃত্ত করিয়াছিলেন।[১]

 মুসলমান লেখকগণ এইরূপে ফর্হাবাগের অশেষ বর্ণনা করিয়া থাকেন। যখন বসন্তের মধুর স্পর্শে উদ্যানস্থ বৃক্ষরাজি নব-পল্লবে পরিশোভিত হইয়া শ্যামলতার ঢেউ খেলাইতে খেলাইতে আকাশের নীলিমার সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রবৃত্ত হইত, নানাবিধ প্রফুল্ল কুসুম আপনাদিগের সুগন্ধ বিতরণে মলয়সমীরণের প্রত্যেক অণুকে অধিবাসিত করিয়া তুলিত, চূতমঞ্জরীর গন্ধে মাতোয়ারা হইয়া পিককুল অবিরত পঞ্চমে তান ছড়াইত এবং অন্যান্য সুকণ্ঠ বিহঙ্গগণের মধুর কাকলীতে চারিদিক মুখর হইয়া উঠিত, সেই সময় নবাব সুজা উদ্দীন কলকণ্ঠী গায়িকাগণের সহিত ফর্হাবাগে সমাগত হইয়া আমোদপ্রমোদে সময় অতিবাহিত করিতেন। ঝর ঝর

  1. Riyaz-us-salatin, p. 292.