পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
২৮
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

সমাধিভবনের উত্তর দিকে ইহার প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করিয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইলে সুজার সমাধিগৃহ দৃষ্ট হয়। প্রায় ৩ হাত উচ্চ একটি বিস্তৃত ভিত্তির উপর সমাধিভবন নির্মিত হইয়াছে। পূর্বের সমাধিভবন ধ্বংসমুখে পতিত হইলে, তাহারই ভিত্তিতে এই নূতন সমাধিভবন নির্মিত হয়। সমাধিভবনটি দৈর্ঘ্যে ১৪ ও প্রস্থে ১৩ হাত হইবে। সম্মুখভাগে তিনটি দ্বার; মধ্যদ্বারে উপরে কৃষ্ণপ্রস্তরফলকে ফারসী ফাষায় লিখিত আছে যে, “১১৫১ হিজরীর ১৩ই জেলহজ্জ মঙ্গলবার সুজা উদ্দৌলা সর্বোচ্চ স্বর্গের অধিবাসিপদ লাভ করেন।” গৃহাভ্যন্তরে সুজা উদ্দীনের বিশাল সমাধি বিরাজ করিতেছে। এরূপ বৃহৎ আকারের সমাধি মুর্শিদাবাদে আর দৃষ্ট হয় না। সমাধিটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭ হাত। গৃহের পশ্চাতে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে একটি ক্ষুদ্র বারাণ্ডা, তাহাতে আর একটি সমাধি আছে। সমাধিভবন হইতে উত্তর-পশ্চিম দিকে এবং সমাধিগৃহ ও প্রবেশদ্বারের মধ্যে একটি ত্রিগম্বুজবিশিষ্ট মস্‌জেদ। এই মস্‌জেদে উপাসনাদি কার্য হইয়া থাকে। মস্‌জেদে হিঃ ১১৫৬ অব্দ লিখিত আছে; এইজন্য ইহা আলিবর্দীর নির্মিত বলিয়া বোধ হয়। মস্‌জেদটি উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্যে ২৩ হাতের অধিক এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থে ১২ হাত হইবে। উত্তরদিকের প্রবেশদ্বার ব্যতীত দক্ষিণদিকে আর একটি ক্ষুদ্র দ্বার আছে; উদ্যানের উত্তর-পূর্ব দিকে প্রহরীদের একটি অসংস্কৃত বাসস্থান রহিয়াছে। সমাধিভবনটির সংস্কার হওয়ায় ইহাকে অত্যন্ত সুন্দর বোধ হইতেছে। আম্র প্রভৃতির বৃক্ষসকল এই সমাধিভবন ও মস্‌জেদকে ছায়া দ্বারা আবৃত করিয়া অতীব মনোরম করিয়া রাখিয়াছে। মুর্শিদাবাদের মধ্যে এরূপ ছায়াময় ও শান্তিময় স্থান অতি বিরল। উদ্যানের স্থানে স্থানে পুষ্পসকল প্রস্ফুটিত হইয়া আছে। রোশনীবাগের সমাধি মন্দিরের নিম্ন দিয়া ভাগীরথী প্রবাহিতা হইতেছেন। বর্ষাকালে তাঁহার সলিলরাশি উদ্যানপ্রাচীরের অতি নিকটে উপস্থিত হয়। বৈদেশিক ভ্রমণকারিগণ ছায়াময় রোশনীবাগের সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন।

 এই সমাধি-উদ্যান মুর্শিদাবাদ কেল্লার সম্মুখস্থ; ইহার নিকটস্থ ভাগীরথীতীরে মুর্শিদাবাদের প্রধান প্রধান উৎসবোপলক্ষে নানারূপ আলোকক্রীড়া হইত, সেইজন্য ইহার নাম রোশনীবাগ। বংশ নির্মিত দ্বিতল, ত্রিতল প্রভৃতি গৃহ আলোকমালায় বিভূষিত করা হইত। ভাগীরথীর অপর পার হইতে নবাববংশীয় ও অন্যান্য সন্ত্রাস্ত জনগণ এই আলোকক্রীড়া দেখিতেন, এবং নদীবক্ষে অনেক লোকে পরিপূর্ণ হইয়া তরণীসকল বিরাজ করিত। যখন কোন প্রধান উৎসব বা পর্বের সময় আসিত, তখনই রোশনীবাগে আলোকের ক্রীড়া হইত। মুর্শিদাবাদে এক্ষণে আর সেরূপ আলোকোৎসব হয় না। কেবল রোশনীবাগের নামমাত্র রহিয়াছে। এক্ষণে কোন কোন সময়ে এই স্থানে সামান্যরূপ আলোকোৎসব দেখা যায়। মুর্শিদাবাদের সমস্ত উৎসব ও পর্ব এক্ষণে জীবনহীন হইয়া পড়িয়াছে। এই সমস্ত দেখিয়া বোধ হয়, মুর্শিদাবাদের গৌরব চিরঅস্তমিত হইতে বসিয়াছে।