পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৬৪
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

মধ্যস্থলে স্থাপিত করা হয়। পূর্বে সোনার প্রদীপ দেওয়া হইত। পরে সেই অগণ্য আলোকপূর্ণ যান ধীরে ধীরে ভাসিতে আরম্ভ করে। যানের অগ্র পশ্চাৎ অসংখ্য কপূরপূর্ণ মৃৎপাত্র প্রজালিত করিয়া ভাসাইয়া দেয়। এই সময়ে অন্যান্য লোকেও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকযান ভাসমান করে। চারিদিকে আলোক-পারিষদ লইয়া সেই সুবৃহৎ আলোকযান নিজামত ব্যাণ্ডের সুমধুর বাদ্যের সহিত অগ্রসর হইতে থাকে। কিয়দ্র গমন করিলে, তীর হইতে আতসবাজী আরম্ভ হয়।

 পূর্বে আতসবাজীর অত্যন্ত ধূম ছিল। মুর্শিদাবাদের পশ্চিমতীরে রোশনীবাগ নামক স্থানে সুবৃহৎ আলোকগৃহ নির্মিত হইত। বংশনির্মিত ত্রিতল গৃহ নানাবিধ কাগজে মণ্ডিত হইয়া, শত শত প্রজ্বলিত দীপ ধারণ করিয়া, পরপারস্থ সহস্রদ্বার ভবনকে উপহাস করিয়া উঠিত। তাহার প্রতিবিম্ব ভাগীরথীবক্ষে পতিত হইলে বোধ হইত, যেন তাহার গর্ভ হইতে একটি উজ্জ্বল আলোকগৃহ ভাসিয়া উঠিতেছে। এই সময়ে নানাবিধ আতসবাজীর দ্বারা সাধারণের মনোরঞ্জন করা হইত। এক্ষণে। আর সেরূপ আলোকগৃহ নির্মিত হয় না এবং আতসবাজীর ধূমও অনেক পরিমাণে লঘু হইয়াছে। এইরূপে ভাগীরথীর বক্ষে ও তীরে সর্বত্রই আলোকের সুন্দর দৃশ্য দর্শকগণের তৃপ্তি সম্পাদন করিত।

 ভাদ্রমাসের মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকারময়ী রজনীতে এইরূপ আলোকের খেলা বাস্তবিক দেখিবার বিষয়। ভাগীরথী আপন হৃদয়ে আলোকের মালা পরিয়াছেন। তীর হইতে অসংখ্য দীপশিখা ও আতসবাজী নৈশ অন্ধকাররাশির মধ্যে হাসিয়া উঠিতেছে। দেখিলেই মনোমধ্যে আনন্দের উদয় হয়। বহুদূর ব্যাপিয়া আলোক আলোক কেবলই আমোক। যে দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, সেই দিকে আলোকতরঙ্গ প্রবাহিত হইতেছে! সমগ্র ভাগীরথীর সলিল-তরঙ্গ যেন আলোক-তরঙ্গে পরিণত হইয়াছে! যেন একটি বিশাল আলোক-প্রবাহ অনন্তজ্যোতিঃসাগরে মিশিবার জন্য অবিরামগতিতে ছুটিয়া যাইতেছে।

 এই উৎসবের দিন পূর্বে নবাবপ্রাসাদের এক বিরাট দরবারের অধিবেশন হইত। দেশীয় ও ইউরোপীয় সম্রান্ত জনগণ সেই দরবারে সমাগত হইতেন। বাঙ্গল, বিহার, উড়িষ্যার নবাব-নাজিম সুচারু পরিচ্ছদে বিভূষিত হইয়া মসনদে উপবেশন করিলে, নিম্নে ইউরোপীয় ও দেশীয়গণ যথানিয়মে নজর প্রদান করিয়া, আপন আপন নিদিষ্ট আসন গ্রহণ করিতেন। সুকণ্ঠী গায়িকার মধুর সঙ্গীত দরবারস্থ সভ্রান্ত লোকদিগের তৃপ্তি সম্পাদন করিত। সহস্রদ্বার ভবনের গোলগৃহে এই দরবারের নির্দিষ্ট স্থান ছিল। এক শত দশ শাখাযুক্ত একটি প্রকাণ্ড কাচের ঝাড় প্রজালিত হইয়া, দরবারগৃহ আলোকময় করিয়া তুলিত। দরবারশেষে মাননীয় ব্যক্তিগণ এক একগাছি বাদলার মালা [১] উপহার গ্রহণ করিয়া আসন পরিত্যাগ করিতেন। এই

  1. সঁচ্চ। গোটানিমিত মালাবিশেষ।