পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

ভার অর্পিত হওয়ায়, অর্থের প্রয়োজনবশতঃ মাণিকচাঁদের সহিত তাঁহার বিলক্ষণ সৌহার্দ্য ঘটে। তাহার পর নবাব আজিমওশ্বানের সহিত মুর্শিদের মনোবিবাদ উপস্থিত হইলে দেওয়ান মুর্শিদকুলী ১৭০৪ খ্রীঃ অব্দে ঢাকা পরিত্যাগ করিয়া, মুর্শিদাবাদে আপনার বাসস্থান নির্দেশ করিলে, রাজস্ববিভাগের যাবতীয় কর্মচারী ও শেঠ মাণিকচাঁদও মুর্শিদাবাদে আসেন। মাণিকচাঁদ মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইয়া ভাগীরথীর পূর্বতীরে মহিমাপুর নামক স্থানে আপনার বাসভবন নির্মাণ করেন। অদ্যপি তাঁহার বংশীয়েরা মহিমাপুরেই বাস করিতেছেন। মুর্শিদকুলী খাঁর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মাণিকচাঁদেরও শ্রীবৃদ্ধি হইতে থাকে। মাণিকচাঁদ মুর্শিদকুলীকে সমস্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করিতেন। এইরূপ কথিত আছে যে, মুর্শিদকুলী বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার নিজামতী পদ প্রাপ্ত হইলে, মুর্শিদাবাদে যে-টাঁকশাল স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা মাণিকচাঁদের পরামর্শানুসারেই করেন। মহিমাপুরের শেঠদিগের বাসভবনের সম্মুখে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে আজিও সেই টাঁকশালের ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হইয়া থাকে। কিন্তু তাহার সমস্তই এক্ষণে ভাগীরথীগর্ভস্থ। নবাবের অনুমতিতে বৎসরের প্রথমে প্রতি বারই পুণ্যাহ হইত। এই সময়ে যাবতীয় জমিদার অথবা তাঁহাদের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত হইয়া আপন-আপন দেয় রাজস্ব প্রদান করিতেন। সেই রাজস্ব দিল্লীতে প্রেরিত হইত। কিন্তু নগদ টাকা প্রেরণে, সময়ে সময়ে অসুবিধা ঘটিত বলিয়া, শেঠগণ রাজস্বপ্রেরণের ভার গ্রহণ করেন। দিল্লী ও আগরাতে শেঠ মাণিকচাঁদের অন্যান্য ভ্রাতাদের যে কুঠি ছিল, তাহাতেই হুণ্ডী পাঠান হইত; পরে তাঁহারা বাদশাহ-সরকারে সমস্ত টাকা উপস্থিত করিতেন। এইরূপে বাঙ্গলার সমস্ত রাজস্ব দিল্লীর রাজকোষে নিরাপদে উপস্থিত হইত।[১] মুর্শিদকুলী খাঁর সময়ে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা রাজস্বপ্রেরণের কথা শুনা যায়।[২] সরকারী অর্থ ব্যতীত নবাবের নিজ অর্থও শেঠদিগের হস্তে ন্যস্ত থাকিত। এইরূপ প্রবাদ আছে যে, মুর্শিদকুলীর মৃত্যুসময়ে তাঁহাদের নিকট নবাবের প্রায় ৭ কোটি টাকা গচ্ছিত ছিল, এবং মুর্শিদের পরবতী কোন নবাব তাহা পুনঃপ্রাপ্ত হন নাই।

 মুর্শিদকুলী খাঁর সহিত মাণিকচাঁদের বিশিষ্টরূপ সৌহার্দ্য থাকায়, নবাব ১৭১৫ খ্রীঃ অব্দে বাদশাহ ফরখ্‌শেরের নিকট হইতে শেঠ উপাধি আনাইয়া তদ্দ্বারা মাণিকচাঁদকে ভূষিত করেন। আবার শেঠদিগের বংশবিবরণীতে এইরূপ শুনা যায় যে, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাঙ্গলার নিজামতিপ্রাপ্তির জন্য মাণিকচাঁদ মুর্শিদকুলীকে যথেষ্ট অর্থসাহায্য করিয়াছিলেন। যাহা হউক, ইহা হইতে বেশ বুঝা যায়, সময়ানুসারে উভয়েই উভয়কে সাহায্য করিতেন। ১৭২২ খ্রীঃ অব্দে মাণিকচাঁদ পরলোক গমন

  1. রিয়াজুস্ সালাতীন গ্রন্থে ১ কোটি ৩০ লক্ষের স্থলে ১ কোটি ৩ লক্ষ লিখিত আছে। (Riyaz-us-salatin, p. 259.)। ফারসী ‘সে’ শব্দে তিন ও ‘সি’ শব্দে ৩০ বুঝায়; ‘স’ লেখার গোলযোগে এইরূপ ঘটিয়া থাকিবে।
  2. Stewart's History of Bengal (New Edition), p. 234.