পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
একটি ক্ষুদ্র কাহিনী
৭৫

 অদ্য আমরা যে ক্ষুদ্র কাহিনীটির বিষয় বলিতেছি, তাহা কোন ইংরেজি ইতিহাসে দৃষ্ট হয় না; কেবল তাহা দুইখানি মুসলমানী ইতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বোধ হয় ঘটনাটিকে অকিঞ্চিৎকর বলিয়া উপেক্ষা করিয়াছেন। দুঃখের বিষয় মুতাক্ষরীনেও ইহার উল্লেখ নাই। কেবল তারিখ বাঙ্গলা নামক ফারসী পুস্তকে ও রিয়াজুস সালাতীন নামক গ্রন্থে এই ক্ষুদ্র কাহিনীটি দেখিতে পাওয়া যায়। আলিবর্দী খা ঁযে সময়ে গিরিয়ার সমরক্ষেত্রে নবাব সরফরাজ খাঁকে নিহত করিয়া, মুর্শিদাবাদের সিংহাসন লাভ করেন, ইহা সেই সময়ের একটি সামান্য ঘটনা মাত্র। ঘটনাটি সামান্য হইতে পারে, কিন্তু ইহাতে হিন্দুর জাতীয়তার একটি বিশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়। চতুর্দিকে প্রজ্বলিত ভীষণ সমরানলের মধ্যে একটি নবমবর্ষীয় বালকের অদ্ভুত পিতৃভক্তি আমাদের জাতীয় ভাবের কি একটি জ্বলন্ত ছবি নহে? অন্যান্য জাতির নিকট উপেক্ষণীয় হইলেও আমাদের নিকট যে ইহা পরম গৌরবের বিষয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমরা সংক্ষেপে ঘটনাটি যথাসাধ্য বর্ণন করিতে প্রয়াস পাইতেছি।

 বিজয়লক্ষীর বরমাল্যলাভের আশায় আলিবর্দী খা ঁও সরফরাজ খা ঁ১৭৪০ খ্রীঃ অব্দের শেষ ভাগে গিরিয়া-প্রান্তরে শিবির সন্নিবেশ করিলেন। গিরিয়ার বিশাল প্রান্তর বিধৌত করিয়া প্রসন্নসলিলা ভাগীরথী কলকল নদে প্রবাহিত হইতেছেন। তাহার উভয় তীরে শিবির সন্নিবেশিত হইয়াছে। সেই সমস্ত শিবিরের ধবল ছবি ভাগীরথীবক্ষে প্রতিবিম্বিত হইয়া তরঙ্গে তরঙ্গে শত শত বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। রাত্রি প্রভাত হইলে, ঊষার বিমলচ্ছটায় চতুর্দি উদ্ভাসিত হইতে লাগিল,—সমস্ত বিশ্বে যেন সজীবতার প্রবাহ ছুটিয়া চলিল,—বিহঙ্গনিচয়ের মধুর ঝঙ্কারে যোদ্ধৃগণের হৃদয়তন্ত্রী যেন বাজিয়া উঠিল। সূর্যদেব দিগ্বলয় আশ্রয় করতে না করিতে উভয় পক্ষের সমরবাদ্য নিনাদিত হইল। হস্তীর বৃংহণে, অশ্বগণের হ্রেষারবে, কামানের গভীর গর্জনে, যোদ্ধগণের উৎসাহনিনাদে, দিল প্রকম্পিত হইতে লাগিল। যুদ্ধ যখন ক্রমে ঘোরতর হইয়া উঠিল, তখন সরফরাজ স্বয়ং উৎসাহসহকারে হস্তীপৃষ্ঠে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তাহার প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষগণের অধিকাংশই ভূতলশায়ী হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় তিনি কাপুরুষতা অবলম্বন না করিয়া নিজেই ভীষণ সমসাগরে ঝম্প প্রদান করিলেন। সহসা একটি বন্দুকের গুলি আসিয়া তাহার মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট হইল এবং তিনি বীরের ন্যায় সেই সমরক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন করিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবদিগের মধ্যে একমাত্র সরফরাজই যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন করিয়াছেন। তাহার প্রধান সেনাপতি গওস খা ঁআলিবর্দীর একদল সৈন্য মথিত করিয়া প্রভুর সাহায্যের জন্য অগ্রসর হইতেছিলেন; পরে প্রভুর মৃত্যুশ্রবণে ঘীয় পুত্রদ্বয়সহ জীবন বিসর্জনে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। অদম্য উৎসাহসহকারে আলিবর্দীর সৈন্যসাগর মন্থন করিতে করিতে পরিশেষে তিনিও ধরাশায়ী হইলেন। তাহার বীরপুত্রদ্বয়ও পিতার পথের অনুসরণ করিলেন।