পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৭৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

 বিজয়সিংহ নামে একজন রাজপুতবীরের হস্তে নবাব সরফরাজের সৈন্যর পশ্চাঁদভাগ রক্ষার ভার ছিল। বিজয়সিংহ গিরিয়ার নিকট খামরা নামক স্থানে শিবির সন্নিবেশ করিয়া অবস্থিতি করিতেছিলেন। যখন তিনি অবগত হইলেন যে, তাহার প্রভুর অধিকাংশ সৈন্যাধ্যক্ষ একে একে গিরিয়ার ভীষণ সমরে জীবন বলি দিয়াছেন এবং প্রভু নিজেও হস্তীপূষ্ঠে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইয়াছেন, তখন তিনি। কালবিলম্ব না করিয়া অতি অল্পসংখ্যক অশ্বারোহীর সহিত আলিবর্দীর দিকে অগ্রসর হইলেন। প্রভুর মৃত্যুতে রাজপুতের শোণিত উষ্ণ হইয়া উঠিল। তিনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া এক ভীষণাকার বল্লম গ্রহণ করিয়া আলিবর্দীকে লক্ষ্য করিলেন,—উজ্জ্বল তপন প্রভায় বল্লম প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। আলিবর্দী খাঁর সমস্ত শরীরে যেন তড়িৎপ্রবাহ ছুটিতে লাগিল। সৌভাগ্যক্রমে তাহার গোলন্দাজ সৈন্যাধ্যক্ষ দাওর কুলীর একটি অব্যর্থ গুলিতে রাজপুতবীর বিজয়সিংহ গিরিয়া-প্রান্তরে শায়িত হইলেন।

 বিজয়সিংহের নবমবর্ষীয় পুত্র জালিমসিংহ ছায়ার ন্যায় পিতার অনুবর্তন করিত; কি শিবিরে, কি সমরক্ষেত্রে, কোন স্থানে তাহার গতির বিরাম ছিল না। যৎকালে বিজয়সিংহ খামরা হইতে গিরিয়া সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হন, শিশু জালিমও তাহার সঙ্গে সেই সমরসাগরের উত্তাল তরঙ্গমধ্যে পতিত হয়। বিজয়সিংহ অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পতিত হইলে, বালক নিষ্কোষিত-তরবারিহস্তে পিতার মৃতদেহ রক্ষার জন্য দণ্ডায়মান হইল। চতুদিকে আলিবর্দীর সেনাগণ জয়নিনাদ করিতেছে,—রণবাদ্যের। ধ্বনিতে দিখণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইতেছে, নবমবর্ষীয় বালকের সূক্ষেপ নাই! সে আপনার ক্ষুদ্র তরবারি লইয়া আলিবর্দীর সৈন্যগণকে বাধা প্রদান করিতে লাগিল। পাছে মুসলমানগণ পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করে, এই আশঙ্কায় সে আপনার প্রাণকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া, ভীষণ সমসাগরমধ্যে নির্ভীকচিত্তে দণ্ডায়মান রহিল। কি যেন মহীয়সী শক্তি তাহার হৃদয়ে ক্রীড়া করিতেছিল; বালক তৎপ্রভাবে পিতার মৃতদেহ। রক্ষার জন্য কৃতসঙ্কল্প হইল। ক্রমশঃ অসংখ্য সৈন্য চতুদিক হইতে বালককে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। জয়োল্লাসে উন্মত্ত হইয়া তাঁহারা যেন বালককে পেষণ করিবার উপক্রম করিল। বালক তাহাতে কিঞ্চিমাত্র বিচলিত না হইয়া, স্বীয় ক্ষুদ্র তরবারি চালনা করিতে লাগিল, তরবারি তপনালোকে ঝলসিত হইয়া যেন নৃত্য করিয়া উঠিল। যতই আলিবর্দীর সৈন্যগণ অগ্রসর হইতেছিল, ততই বালকের উৎসাহ বর্ধিত হইতে লাগিল। যে রাজপুত জাতি জগতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বীরত্বের অভিনয়। করিয়াছে, তাহাদের সামান্য রক্তবিন্দুও যে সজীব, ইহা কে অস্বীকার করিবে?

 আলিবর্দী খা ঁস্বয়ং সেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বালকের অদ্ভুত সাহসে ও পিতৃভক্তিতে চমৎকৃত হইয়া সৈন্যগণকে তাহার গাত্র স্পর্শ করিতে নিষেধ করিলেন এবং স্বীয় হিন্দু সৈনিকগণকে বিজয়সিংহের মৃতদেহের যথারীতি সৎকার করিতে আদেশ দিলেন। এই আদেশ অবগত হইয়া বালক তাহাদিগকে পিতার দেহস্পর্শে অনুমতি দিল। আলিবর্দীর কতিপয় গোলন্দাজ সৈন্য বালকের অদ্ভুত