পাতা:মেজদিদি - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাশার ছক পাতা হইয়াছে। সে প্রথমেই দৃঢ় আপত্তি প্রকাশ করিয়া কহিল, আমি কিছুতেই বসতে পারব না-আমার ভারি মাথা ধরেছে। বলিয়া ঘরের এক কোণে সরিয়া গিয়া, তাকিয়া মাথায় দিয়া, চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল। বন্ধুরা মনে মনে কিছু আশ্চর্য্য হইল এবং লোকাভাবে পাশা তুলিয়া দাবা পাতিয়া বসিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক চেঁচামেচি ঘটিল, কিন্তু সত্য একবার উঠিল না, একবার জিজ্ঞাসা করিল না-কে হারিল, কে জিতিল। আজ এসব তাহার ভাল লাগিল না।

 বন্ধুরা চলিয়া গেলে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়া সোজা নিজের ঘরে যাইতেছিল, ভাডারের বারান্দা হইতে মা জিজ্ঞাসা করিলেন, এর মধ্যে শুতে যাচ্ছিস যে রে?

 শুতে নয়, পড়তে যাচ্ছি। এম. এ’র পড়া সোজা নয় ত! সময় নষ্ট করলে চলবে কেন? বলিয়া সে গৃঢ় ইঙ্গিত করিয়া দুম্‌দুম্‌ শব্দ করিয়া উপরে উঠিয়া গেল।

 আধঘণ্টা কাটিয়াছে, সে একটি ছত্রও পড়ে নাই। টেবিলের উপর বই খোলা, চেয়ারে হেলান দিয়া, উপরের দিকে মুখ করিয়া কড়িকাঠ ধ্যান করিতেছিল, হঠাৎ ধ্যান ভাঙিয়া গেল। সে কান খাড়া করিয়া শুনিল—ঝুম। আর এক মুহুর্ত—ঝুম্‌ঝুম্‌। সত্য সোজা উঠিয়া বসিয়া দেখিল, সেই আপাদমস্তক গহনা-পরা লক্ষ্মীঠাকুরুণাটির মত মেয়েটি ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সত্য একদৃষ্টি চাহিয়া রহিল।

 মেয়েটি মৃদুকণ্ঠে বলিল, মা আপনার মত জিজ্ঞাসা করলেন।

 সত্য মুহুর্ত মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কার মা?

 মেয়েটি কহিল, আমার মা।

 সত্য তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তর খুঁজিয়া পাইল না, ক্ষণেক পরে কহিল, আমার মাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন।

 মেয়েটি চলিয়া যাইতেছিল, সত্য সহসা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, তোমার নাম কি?

 আমার নাম রাধারাণী, বলিয়া সে চলিয়া গেল।

৪৩