পাতা:য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নবম পত্র: পাদটীকা



১৫৯

    খেয়াল ধ্রুপদ গান করা আর ভক্তিভাজন ব্যক্তির সহিত সখ্যরসের আলাপ করা উভয়ই সমান— বেসুরো, বেতালা, বেমানান— সমজদার ব্যক্তি তাহা শুনিবা মাত্র কানে হাত দেন। ভা. স.

    অবশ্য, শৈশবকালে এইরূপ আচরণই স্বাভাবিক, কিন্তু একজন ষোলো-বর্ষ-বয়স্ক পুত্র ওরূপ ব্যবহার করিলে সেটা অত্যন্ত বেতালা ও বেসুরো হয় কি না একবার ভাবিয়া দেখা হউক— একটু যাহার বুদ্ধি হইয়াছে সে পুত্র শুধু-শুধু কেনই বা ওরূপ করিবে! ষোলো বর্ষের বালক পিতার নিকট পাঁচ বর্ষের শিশুর ভাণ করিয়া, অথবা দম্পতিপ্রেমোচিত অধীর ভালোবাসার ভাণ করিয়া দৌড়াদৌড়ি পিতাকে আলিঙ্গন করিলে সে যে কী এক অদ্ভুত দৃশ্য হয় তাহা বর্ণনাতীত। ভা. স.

    গুরুজনের সঙ্গে সখ্যরসের আলাপ করা অস্বাভাবিক কি স্বাভাবিক ইহা হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করো—যিনি সর্বতোভাবে ভালো চান তাঁকে কোনোরূপে কোনো পীড়া দিতে তুমি চাও না; তুমি জানো যে তোমার কোনো বিষয়ে একটু কিছু ত্রুটি দেখিলে তাঁহার মনে যত লাগিবে এত আর কাহারও মনে লাগিবে না— এইজন্য তাঁর কাছে তুমি ভয়-ভয় করিয়া চল। ইহা নিশ্চয় জানিয়ো এরূপ ভয় ভালোবাসা হইতেই জন্মগ্রহণ করে; পুত্র যদি পিতাকে ভালো না বাসে তবেই সে তাহার পিতার মনে আঘাত দিতে কিছুমাত্র ভীত বা সংকুচিত হয় না—সুতরাং সে-তাহার-ভয় কঠোর শাসন-ভয় হওয়া দূরে থাকুক, তাহা অতি সুকোমল ভালোবাসার ভয়, সুতরাং অতি সন্তর্পণে রাখিবার সামগ্রী। বন্ধুবর্গের সহিত যখন আমরা সখ্যরসে মিলিত হই তখন আমরা অনেকটা অসংকোচ ভাবে চলা-বল। করি— কেন? না, বন্ধুরা পিতার ন্যায় আমাদের মঙ্গলের জন্য একান্ত লালায়িত নহে; বন্ধুদিগের লক্ষ্য আমোদপ্রমোদের দিকে— আমোদ-প্রমোদের পক্ষে ঢিলাঢালা ভাব যেমন আবশ্যক মঙ্গলের পক্ষে সংযত ভাব তেমনি আবশ্যক। বন্ধুমণ্ডলীর মধ্যে মনের শৈথিল্য স্বভাবতঃ শোভা পায়, গুরুজন-সন্নিধানে মনের সংযত ভাব স্বভাবতঃ শোভা পায়— তা যদি না বলো তবে ভক্তি শব্দটাকে অভিধান হইতে উঠাইয়া দেও। ভা. স.