পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

ছুরিটা সবলে পিছ্‌লে আমার বাম হাতের দুই আঙুলের উপর এসে পড়ল। রক্ত চার দিকে ছিটকে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ আহারে ভঙ্গ দিয়ে ক্যাবিনে পলায়ন করলুম। মনে এই আক্ষেপ হতে লাগল, এতখানি রক্তের অনর্থক অপব্যয় হল অথচ স্বদেশ যেমন ছিল তেমনি রইল, সাধারণ মানবেরও অবস্থার কোনাে উন্নতি হল না, মাঝের থেকে এই ঘটনাটা যদি বাড়িতে ঘটত তা হলে যে পরিমাণ স্নেহ শুশ্রূষা এবং ছিন্ন অঞ্চলখণ্ড আহত অঙ্গুলির চতুর্দিকে আকৃষ্ট হত অদৃষ্টে তাও জুটল না। ইতিহাসে অনেক রক্তপাত লিপিবদ্ধ হয়েছে, আমার ডায়ারিতে আমার এই রক্তপাত লিখে রাখলুম― ভাবী বঙ্গবীরদের কাছে গৌরবের প্রার্থী নই, বর্তমান বঙ্গাঙ্গনাদের মধ্যে কেউ যদি একবার ‘আহা’ বলেন!

 ১ সেপ্টেম্বর। সন্ধ্যার পর আহারান্তে উপরের ডেকে আমাদের যথাস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করা গেল। মৃদু শীতল বায়ুতে আমার বন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছেন, এবং দাদা অলসভাবে ধুম সেবন করছেন, এমন সময়ে নীচের ডেকে নাচের বাজনা বেজে উঠল। সকলে মিলে জুড়ি জুড়ি ঘূর্ণনৃত্য আরম্ভ হল।

 তখন পূর্বদিকে নব কৃষ্ণপক্ষের পূর্ণপ্রায় চন্দ্র ধীরে ধীরে উদয় হচ্ছে। এই তীররেখাশূন্য জলময় মহামরুর পূর্বসীমান্তে চন্দ্রের পাণ্ডুর কিরণ প’ড়ে একটা অনাদি অনন্ত বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চাঁদের উদয়পথের ঠিক নীচে থেকে আমাদের জাহাজ পর্যন্ত অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে প্রশস্ত দীর্ঘ আলােকপথ ঝিক্‌ঝিক্ করছে। জ্যোৎস্নাময়ী সন্ধ্যা কোন্‌-এক অলৌকিক বৃন্তের উপরে অপূর্ব শুভ্র জনীগন্ধার মতাে আপন প্রশান্ত সৌন্দর্যে নিঃশব্দে চতুর্দিকে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। আর, মানুষগুলাে পরস্পরকে জড়াজড়ি ক‘রে ধ’রে পাগলের মতাে তীব্র আমােদে ঘুরপাক খাচ্ছে, হাঁপাচ্ছে,

৮৪