পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, সর্বাঙ্গের রক্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরছে, বিশ্বজগৎ আদিসৃষ্টিকালের বাষ্পচক্রের মতাে চারি দিকে প্রবল বেগে আবর্তিত হচ্ছে। আশ্চর্য কাণ্ড! লােকলােকান্তরের নক্ষত্র স্থিরভাবে চেয়ে রয়েছে এবং দূরদূরান্তরের তরঙ্গ ম্লান চন্দ্রালােকে গম্ভীর সমস্বরে অনন্তকালের পুরাতন সামগাথা গান করছে। এই রজনীতে, এই আকাশের নীচে এবং এই সমুদ্রের উপরে, কতকগুলি পরিচিত অপরিচিত নরনারী জুড়ি জুড়ি জড়াজড়ি ক’রে লাঠিমের মতাে অর্থহীন অন্ধবেগে ঘুর খাওয়াকে খুব একটা সুখ মনে করছে। একটু লজ্জা নেই, সংযম নেই, চিন্তা নেই, পরস্পরের মধ্যে একটা শােভন অন্তরাল নেই। আমার কাছে এই উম্মত্ত বর্বরতা লেশমাত্র সুন্দর ঠেকে না। লজ্জা কি কেবলমাত্র কৃত্রিম নিয়ম! অনাত্মীয় স্ত্রীপুরুষ অকস্মাৎ ঘনিষ্ঠ বাহুবন্ধনে মুখে মুখে বক্ষে বক্ষে সম্বদ্ধ হতে কি একটা স্বাভাবিক আন্তরিক সুগভীর সংকোচ অনুভব করে না! এমন-কি, যে দেশে অসভ্যেরা বস্ত্রমাত্র পরে না সে দেশেও কি এই আদিম লজ্জাটুকু, প্রেমনীতির এই প্রথম অঙ্কুরটুকুও নেই!

 ২ সেপ্টেম্বর। সকালে ডেকে বেড়াবার সময় একটি ইংরাজ ভদ্রলােকের সঙ্গে আমার বহুক্ষণ আলাপ হল। ইনি ভারতরাজ-মন্ত্রণার একটি প্রধান আসন অধিকার করেন। প্রথমে য়ুরােপের সমাজসমস্যা সম্বন্ধে আমি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলুম, তার কতক কতক আমার ভূমিকাতে ব্যক্ত করা গেছে। সাহেব জনসংখ্যাবৃদ্ধি-বশতঃ বেহার প্রভৃতি দরিদ্র দেশের ভাবী আশঙ্কা এবং কুলি-চালান সম্বন্ধে বাঙালী কাগজের অনভিজ্ঞ চীৎকারের কথা বললেন; এবং দেশের ঐতিহাসিক প্রকৃতি আলােচনা করে ভারতবর্ষে প্রতিনিধিতন্ত্র-প্রচার সম্বন্ধে দৃঢ় আপত্তি প্রকাশ করলেন।

৮৫