পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

আমি বললুম, ‘দেখাে সাহেব, প্রতিনিধিতন্ত্রের জন্য যে আমরা আন্তরিক লালায়িত এরূপ কোনাে লক্ষণ দেখা যায় না। আসল কথা, তােমরা সর্বদা আমাদের প্রতি প্রকাশ্য ঔদ্ধত্য এবং অবজ্ঞা দেখিয়ে থাকো, সেইটেই আমাদের শিক্ষিত লােকদের পক্ষে অসহ্য। অন্তরের মধ্যে সেই অপমান অনুভব করি ব’লেই আমরা জাতীয় আত্মসম্মান রক্ষা করবার জন্যে আজ এত চেষ্টা করছি। নইলে, তােমাদের জাতের স্বভাবটা যদি একটু নরম হত— আমরা যদি তােমাদের কাছ থেকে যথার্থ ভদ্রতা, কথঞ্চিৎ সম্মান ও মনুষ্যোচিত সদয় ব্যবহার পেতুম— তা হলে আমাদের শিক্ষিতমণ্ডলীর মধ্যে থেকে এ রকম বেদনার স্বর শুনতে পেতে না। আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান দুর্দশা হচ্ছে এই যে, যারা আমাদের আন্তরিক ঘৃণা করে তারাই আমাদের বলপূর্বক উপকার করতে আসে। যারা আমাদের মানুষ জ্ঞান করে না তারাই আমাদের শান্তি রক্ষা করে, লেখাপড়া শেখায়, সুবিচার করবার চেষ্টা করে। প্রতিদিন এ রকম অবজ্ঞার দান গ্রহণ করতে বাধ্য হলে আমাদের আত্মসম্মান আর থাকে না। স্নেহের দানে হীনতা নেই। স্নেহের সম্পর্কে সহস্র অবিচার থাকতে পারে কিন্তু অপমান নেই। ধনীগৃহের একটি অনাদৃত উপেক্ষিত আশ্রিতের মতাে আমরা পাকা কোঠায় থাকি, উদ্‌বৃত্ত পরমান্ন খাই, সুখ বিস্তর আছে কিন্তু হীনতার আর সীমা নেই— সে কেবলমাত্র আন্তরিক প্রীতি-বন্ধনের অভাবে।

 ৩ সেপ্টেম্বর। আজ সকালেও সেই ভদ্রলোেকটির সঙ্গে আমার অনেক কথা হল। তিনি লর্ড্‌ ডাফারিনের বিদায়কালে তাঁর প্রতি বাঙালী দেশহিতৈষীদের রূঢ় আচরণের অনেক নিন্দাবাদ করলেন।

 বেলা দশটার সময় সুয়েজ খালের প্রবেশমুখে এসে জাহাজ থামল। চারি দিকে চমৎকার রঙের খেলা। পাহাড়ের উপর রৌদ্র

৮৬