পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি। সেখানে আমি সকলকে চিনি, সকলকে বুঝি; সেখানে সমস্ত বাহ্যাবরণ ভেদ করে মনুষ্যত্বের আস্বাদ সহজে পাই। সহজে উপভােগ করতে পারি, সহজে চিন্তা করতে পারি, সহজে ভালােবাসতে পারি। যেখানে আসল মানুষটি আছে সেখানে যদি অবাধে যেতে পারতুম, তা হলে আপনার স্বজাতীয়কে দেখে এ স্থানকে আর প্রবাস বলে মনে হত না। কিন্তু তােমাদের সাহিত্যের মধ্যে যাদের সঙ্গে প্রত্যহ সাক্ষাৎ হয় তােমাদের সমাজের মধ্যে তাদের দর্শন পাওয়া দুর্লভ। কারণ, সাহিত্যে সমস্ত বাত্যাবরণ দুর করে অন্তরঙ্গ মানুষটিকে টেনে এনে বিনা ভূমিকায় এবং বিনা পরিচয়পত্রে মিলন করিয়ে দেয়। তখন ভ্রম হয় ইংলন্‌ডে পদার্পণ করবামাত্রই এই-সব মানুষের সঙ্গে বুঝি পথে ঘাটে সম্মিলন হবে। কিন্তু এখানে এসে দেখি কেবল ইংরাজ, কেবল বিদেশী; তাদের চালচলন ধরণধারণ যা-কিছু নূতন সেইটেই কেবল ক্রমিক চক্ষে পড়ে, যা চিরকেলে পুরাতন সেটা ঢাকা পড়ে থাকে; সেইজন্যে এদের সঙ্গে কেবল পরিচয় হতে থাকে, কিন্তু প্রণয় হয় না।

 এইখানে কথামালার একটা গল্প মনে পড়ছে।―

 একটা চতুর শৃগাল একদিন সুবিজ্ঞ বককে আহারে নিমন্ত্রণ করেছিল। বক সভায় গিয়ে দেখে বড়াে বড়াে থালা সুমিষ্ট লেহ্য পদার্থে পরিপূর্ণ। প্রথম শিষ্ট সম্ভাষণের পর শৃগাল বললে, ‘ভাই, এসাে, আরম্ভ করে দেওয়া যাক।’ বলেই তৎক্ষণাৎ অবলীলাক্রমে লেহন করতে প্রবৃত্ত হল। বক তার দীর্ঘ চঞ্চু নিয়ে থালার মধ্যে যতই ঠোকর মারে মুখে কিছুই তুলতে পারে না। অবশেষে চেষ্টায় নিবৃত্ত হয়ে স্বাভাবিক অটল গাম্ভীর্য অবলম্বন -পূর্বক সরােবরকূলের ধ্যানে নিমগ্ন হল। শৃগাল বােধ করি মাঝে মাঝে কটাক্ষপাত

১০৭