পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা

অনেক দিন থেকে ইচ্ছা ছিল য়ুরোপীয় সভ্যতার ঠিক মাঝখানটাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে একবার তার আঘাত আবর্ত এবং উন্মাদনা, তার উত্তাল তরঙ্গের নৃত্য এবং কলগীতি, অট্টহাস্য করতালি এবং ফেনোচ্ছ্বাস, তার বিদ্যুৎবেগ, অনিদ্র উদ্যম এবং প্রবল প্রবাহ সমস্ত শিরা স্নায়ু ধমনীর মধ্যে অনুভব করে আসব। বহুকাল তীরে বসে বসে বালির ঘর গড়ছি এবং ভাঙছি, এবং ভাবছি, ইতিমধ্যে বন্ধুবান্ধবেরা একে একে অনেকেই নিজ নিজ শক্তি অনুসারে সমুদ্রমন্থন সমাপন করে এলেন; এমনি উৎসাহ যে শুষ্কতীরে ফিরে এসেও তাঁরা হস্তপদ-আস্ফালন কিছুতেই নিবৃত্ত করতে পারছেন না। আমিও তাই দেখে কৌতূহলবশতঃ একদিন অপরাহ্ণে ঐ তরঙ্গিত অগাধ রহস্যরাশির মধ্যে আনন্দে অবতরণ করেছিলুম, মুহূর্তের মধ্যে খুব খানিকটা নাড়াচাড়া হাবুডুবু এবং লোনা জল খেয়ে অচিরাৎ উঠে এসেছি। এখন কিছুদিন ভাঙার উপরে সর্বাঙ্গ বিস্তারপূর্বক চক্ষু মুদ্রিত করে রোদ পোহাব মনে করছি।

 আমরা পুরাতন ভারতবর্ষীয়; বড়ো প্রাচীন, বড়ো শ্রান্ত। আমি অনেক সময়ে নিজের মধ্যে আমাদের সেই জাতিগত প্রকাণ্ড প্রাচীনত্ব অনুভব করি। মনোযোগপূর্বক যখন অন্তরের মধ্যে নিরীক্ষণ করে দেখি তখন দেখতে পাই, সেখানে কেবল চিন্তা এবং বিশ্রাম এবং বৈরাগ্য। যেন অন্তরে বাহিরে একটা সুদীর্ঘ ছুটি। যেন জগতের প্রাতঃকালে আমরা কাছারির কাজ সেরে এসেছি, তাই এই উত্তপ্ত মধ্যাহ্নে যখন আর সকলে কার্যে নিযুক্ত তখন আমরা দ্বার রুদ্ধ করে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করছি; আমরা আমাদের পূরা বেতন চুকিয়ে নিয়ে কর্মে ইস্তাফা দিয়ে পেন্‌সনের উপর সংসার চালাচ্ছি। বেশ আছি।