পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

আমোদের উদ্দেশেও, মানুষের শক্তি আপন পেশী এবং স্নায়ু চরম সীমায় আকর্ষণ করে খেটে মরছে।

 জাহাজে বসে ভাবতুম এই-যে জাহাজটি অহর্নিশি লৌহবক্ষ বিস্ফারিত করে চলেছে, ছাদের উপরে নরনারীগণ কেউ বা বিশ্রামসুখে কেউ বা ক্রীড়াকৌতুকে নিযুক্ত, কিন্তু এর গোপন জঠরের মধ্যে যেখানে অনন্ত অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে, যেখানে অঙ্গারকৃষ্ণ নিরপরাধ নারকীরা প্রতিনিয়তই জীবনকে দগ্ধ করে সংক্ষিপ্ত করছে—সেখানে কী অসহ্য চেষ্টা! কী দুঃসাধ্য পরিশ্রম! মানবজীবনের কী নির্দয় অপব্যয় অশ্রান্তভাবে চলছে! কিন্তু, কী করা যাবে! আমাদের মানবরাজা চলেছেন; কোথাও তিনি থামতে চান না; অনর্থক কাল নষ্ট কিম্বা পথকষ্ট সহ্য করতে তিনি অসম্মত।

 তাঁর জন্যে অবিশ্রাম যন্ত্রচালনা করে কেবলমাত্র দীর্ঘ পথকে হ্রাস করাই যথেষ্ট নয়; তিনি প্রাসাদে যেমন আরামে যেমন ঐশ্বর্যে থাকেন পথেও তার তিলমাত্র ত্রুটি চান না। সেবার জন্যে শত শত ভৃত্য অবিরত নিযুক্ত; ভোজনশালা সংগীতমণ্ডপ সুসজ্জিত, স্বর্ণচিত্রিত, শ্বেতপ্রস্তরমণ্ডিত, শত বিদ্যুদ্দীপে সমুজ্জ্বল। আহারকালে চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়ের সীমা নেই। জাহাজ পরিষ্কার রাখবার জন্যে কত নিয়ম কত বন্দোবস্ত; জাহাজের প্রত্যেক দড়িটুকু যথাস্থানে সুশোভনভাবে গুছিয়ে রাখবার জন্যে কত দৃষ্টি।

 যেমন জাহাজে, তেমনি পথে ঘাটে দোকানে নাট্যশালায় গৃহে সর্বত্রই আয়োজনের আর অবধি নেই। দশ দিকেই মহামহিম মানুষের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের ষোড়শোপচারে পূজা হচ্ছে। তিনি মুহূর্তকালের জন্যে যাতে সন্তোষ লাভ করবেন তার জন্যে সম্বৎসরকাল চেষ্টা চলছে।

৩৮