পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 য়ুরােপ, য়ুরােপীয় সভ্যতা, শােনবামাত্র অস্তাচলের পরপারবর্তী এক নূতনজ্যৈাতিরালােকিত অপূর্ব দূরজগতের ভাব সহজেই কল্পনায় উদয় হওয়া উচিত। সেখানে যাত্রা আরম্ভ করবার পূর্বে মনে যথেষ্ট ভয় এবং যথেষ্ট সম্ভ্রমের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের বালকটি বালিকা নববধুর গহনা বিক্রয় এবং বৃদ্ধ পিতার বহুদুঃখসঞ্চিত অর্থ অপহরণ ক’রে সেখানে অনায়াসে নিশ্চিন্ত মনে নিরুদ্বেগে শ্মশ্রূদগমের কিঞ্চিৎ পূর্বেই গােপনে পলায়ন করে এবং শ্মশ্রূদগমের কিঞ্চিৎ পরেই বেশ বদল ক’রে, ঘাড়ের চুল ছেঁটে, দুই রিক্ত পকেটে দুই হাত গুঁজে দিয়ে, বাপের কোম্পানির কাগজ এবং চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে অত্যন্ত চটুল চঞ্চল ভাবে দেশে ফিরে আসে। এই কলেছাঁটা ছােকরাটি যে উনবিংশ শতাব্দীর তীর্থস্থানে গিয়ে মহাসমুদ্রের ঢেউ খেয়ে এসেছে এমনটা কিছুতেই মনে হয় না। মনে হয়, কোন্ এক শখের নাট্যশালায় কিছুকাল অভিনয় করে এল; সেখানকার বাঁকা সুর এখনাে মুখে লেগে আছে, এবং সেখানকার অধিকারীমহাশয় অনুগ্রহপূর্বক সাজের বেশখানি একে দান করেছেন; আর কোনােরকম পারিতােষিক দিয়েছেন কি না বলতে পারি নে।

 কিন্তু দেশকালের ঘনিষ্ঠতা যতই হ্রাস হােক, চিরকালের অভ্যাস একেবারে যাবার নয়। যদিও তিন মাসের রিটার্‌ন্‌ টিকিট মাত্র নিয়ে য়ুরোপে চলেছি, তবু একটা কাল্পনিক দীর্ঘকালের বিভীষিকা মন থেকে তাড়াতে পারছি নে। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিনের জন্যে চলেছি।

 এমনতর ঘটনা শােনা যায় যে, ক্ষতচিকিৎসায় একজন লােকের একটা পায়ের আধখানা কেটে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আজন্মকালের অভ্যাসবশতঃ সেই বিচ্ছিন্ন অংশের অস্তিত্ব কিছুতেই তার মন থেকে দূর হয় না। তেমনি ভারতবর্ষ এবং য়ুরােপের মাঝখানে স্বভাবতঃ যে-

৬২