পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

না। তেমনি স্বাস্থ্যের বেগে যার শরীর চঞ্চল হয়ে উঠেছে, শান্ত নিরুদ্‌বিগ্নভাবে কেবলমাত্র জীবনধারণের মধ্যে যে সুখটুকু আছে সে তাকে এক লম্ফে লঙ্ঘন করে চলে যায়।

 ধনই হােক, সুখই হােক, স্বাস্থ্যই হােক, যতটুকু আমাদের প্রাত্যহিক আবশ্যকে লাগে ততটুকু নিয়মিত কাজে ব্যাপৃত থাকে। তার অতিরিক্ত যেটুকু সেইটুকুই আমাদের অস্থির করে তােলে। সে কিছুতে বেকার বসে থাকতে চায় না। ধন ধনীকে কেবল প্রশ্ন করে, খাওয়া পরা তাে হল, এখন কী করব বলো। সুখ বলে, প্রাত্যহিক জীবনটা তাে এক রকম নিঃশব্দে কাটছে, এখন তার উপরে একটা-কিছু সমারােহ না করলে টিঁকতে পারি নে। স্বাস্থ্য বলে, আর-কিছু যদি করবার না থাকে তাে নিদেন হূহূঃ শব্দে দুটো ডন ফেলে আসা যাক।

 সেই জন্যেই আমরা ভারতবাসীরা বলে থাকি সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালাে, অনুরাগের চেয়ে বৈরাগ্যে ঢের কম ল্যাঠা― ভিতর থেকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে খাটিয়ে মারবার কেউ থাকে না। সুখ দুর্বলের জন্যে নয়— সুখ বলসাধ্য, সুখ দুঃখসাধ্য। অক্সিজেন প্রতি মুহূর্তে যেমন আমাদের দগ্ধ করে জীবন দেয়, মানসিক জীবনে সুখ সেই রকম আমাদের দাহ করতে থাকে। যৌবনে এই দাহ যে রকম প্রবল বার্ধক্যে সে রকম নয়; এই জন্যে বৃদ্ধ জাতি এবং বৃদ্ধ লােকেরাই বলে থাকেন, সন্তোষই যথার্থ সুখ, অর্থাৎ তাপহ্রাসই যথার্থ জীবন।

 য়ুরোপ মনুষ্যের নব নব অভাব সৃষ্টি ক’রে সেইটাকে মােচন করাকেই সুখ বলে, আমরা মনুষ্যের ক্ষুধাতৃষ্ণা প্রভৃতি চিরসঙ্গী আজন্ম-অভাবগুলিকেও খােরাক-বন্ধ ও অন্যান্য কৌশল দ্বারা হ্রাস করে বসে থাকাকেই সন্তোষ বলি।

৭৫