পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 আমি সেই প্রাচীন ভারত -সন্তান। পায়ের উপর একখানি কম্বল চাপিয়ে লম্বা চৌকির উপর হেলান দিয়ে ভারতমাতার আর-একটি দুর্বল সন্তানকে সামনে বসিয়ে প্রত্যুষ থেকে মধ্যাহ্ন, মধ্যাহ্ন থেকে অপরাহ্ণ, অপরাহ্ণ থেকে অর্ধরাত্রি পর্যন্ত কখনাে স্বগত তত্ত্বালােচনা, কখনাে জনান্তিকে গল্প, কখনাে নিস্তব্ধভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকাকেই পরম সুখের অবস্থা মনে করছি। শরীরে যতটুকু তেজ আছে তাতে কেবল এইটুকুমাত্রই সম্পন্ন হতে পারে। আর, ঐ ইংরাজের ছেলেগুলাে আমাদের সম্মুখ দিয়ে অবিশ্রাম পায়চারি করে করে মােলাে। তাদের অপরিমিত স্বাস্থ্য কিছুতেই তাদের বসে থাকতে দিচ্ছে না; পিছনে পিছনে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সময়ে আমরা আমাদের নিবৃত্তিসিংহাসনের উপরে রাজবৎ আসীন হয়ে ভারতবাসীর নির্‌গুণাত্মক আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠতা অনুভব করছি। এবং মনে হচ্ছে ইংরাজের ছেলেরাও আমাদের এই অটল ঔদাসীন্য এই নিশ্চেষ্ট অনাসক্তি দেখে নিজেদের হীনতা স্পষ্টই বুঝতে পারছে, তাই আরও ছট্‌ফট্‌ করে বেড়াচ্ছে।

 কিন্তু বাহ্য আকৃতি থেকে আমাদের দুটিকে দিবসের পেচকের মতাে যতটা আধ্যাত্মিক দেখায়, আমাদের আলােচনাতে সকল সময়ে ততটা সাত্ত্বিক সৌরভ থাকে না। সকলের জানা উচিত যদিচ আমরা ভারতসন্তান কিন্তু তবু আমাদের বয়স এখনও ত্রিশ পেয়ােয় নি। এখনো আমাদের সন্ন্যাসাশ্রমের সময় আছে। এই বয়সেই ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে বৈরাগ্য হাড়ের মধ্যে প্রবেশ ক’রে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়, কিন্তু মনের মধ্যে এখনাে কিঞ্চিৎ উত্তাপ আছে। এই জন্যে আমরা দুই যুবক গতকল্য রাত্রি দুটো পর্যন্ত কেবল ষড়্‌চক্র-ভেদ চিত্তবৃত্তি-নিরােধ ত্রিগুণাত্মিকা-শক্তি

৭৬