পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

এমন একটা জায়গায় এসে থেমেছে যার ঊর্ধ্বে আর গতি নেই, পরিবর্তন নেই— যা অনন্তকাল অবিশ্রাম চাঞ্চল্যের পরম পরিণতি, চরম নির্বাণ। সূর্যাস্তের সময় চিল আকাশের নীলিমার যে-একটি সর্বোচ্চ সীমার কাছে গিয়ে সমস্ত বৃহৎ পাখা সমতল রেখায় বিস্তৃত করে দিয়ে হঠাৎ গতি বন্ধ করে দেয়, চিরচঞ্চল সমুদ্র ঠিক যেন সহসা সেই রকম একটা পরম প্রশান্তির শেষ সীমায় এসে ক্ষণেকের জন্য পশ্চিম অস্তাচলের দিকে মুখ তুলে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলের যে চমৎকার বর্ণবিকাশ হয়েছে সে আকাশের ছায়া কি সমুদ্রের আলো ঠিক বলা যায় না। যেন একটা মাহেন্দ্রক্ষণে আকাশের নীরব নির্নিমেষ নীল নেত্রের দৃষ্টিপাতে হঠাৎ সমুদ্রের অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্যে থেকে একটা আকস্মিক প্রতিভার দীপ্তি স্ফূর্তি পেয়ে তাকে অপূর্বমহিমান্বিত করে তুলেছে।

 সমুদ্র এবং আকাশের অসীম স্তব্ধতার মধ্যে এই আশ্চর্য বর্ণের উদ্ভাস দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছে এইটেকে ঠিক ব্যক্ত করতে পারি এমন ভাষা আমার কোথায়! কিন্তু আবার ভাবি, আবশ্যক কী? এ চঞ্চলতা কেন? বৃহৎকে ছোটোর মধ্যে বেঁধে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে হবে এ কী রকমের দুশ্চেষ্টা! এই দুর্গম দুর্লভ বাক্যহীন এবং অনির্বচনীয় প্রকাণ্ড সুন্দরী প্রকৃতির একটি পকেটসাইজের সুলভ সংস্করণ জেবের মধ্যে পূরতে না পারলে মনের ক্ষোভ মেটে না; মাঝের থেকে এই ছট্‌ফটানির জ্বালায় যতটুকু সহজে পাওয়া যেতে পারত তাও হাতছাড়া হয়!

 কিন্তু তবু― সমুদ্র এবং আকাশের মাঝখানটি থেকে এই দুর্লভ সন্ধ্যাটুকুকে পারিজাতপুষ্পটির মতো তুলে নিয়ে যদি আর-এক জনের হাতে না দিতে পারি তা হলে মনে হয় যেন সমস্ত নিষ্ফল হল। এই আলো এই শান্তি কেবল একা বসে চেয়ে দেখবার এবং

৮০