পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

 কী হচ্ছে দেখবার জো নেই বলে নন্দরানীর মন রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে আছড়ে আছড়ে কাঁদতে লাগল। ঘরে কাজকর্ম, লােককে খাওয়ানো দাওয়ানাে, দেখাশুনা হাসিমুখেই করতে হয়। বুকের মধ্যে কাঁটাটা নড়তে-চড়তে কেবলই বেঁধে, প্রাণটা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে, কেউ জানতে পারে না। ওদিকে থেকে-থেকে তৃপ্ত কণ্ঠের রব ওঠে, জয় হােক রানীমার।

 অবশেষে উৎসবের মেয়াদ ফুরােল, বাড়ি হয়ে গেল খালি। কেবল ছেঁড়া কলাপাতা ও সরা-খুরি-ভাঁড়ের ভগ্নাবশেষের উপর কাক-কুকুরের কলররমুখর উত্তরকাণ্ড চলছে। ফরাশেরা সিঁড়ি খাটিয়ে লণ্ঠন খুলে নিল, চাঁদোয়া নামাল, ঝড়ের টুকরো বাতি ও শােলার ফুলের ঝালরগুলাে নিয়ে পাড়ার ছেলেরা কাড়াকাড়ি বাধিয়ে দিল। সেই ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে চড়ের আওয়াজ ও চীৎকার কান্না যেন তারস্বরের হাউইয়ের মতাে আকাশ ফুঁড়ে উঠছে। অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণ থেকে উচ্ছিষ্ট ভাত-তরকারির গন্ধে বাতাস অম্লগন্ধী; সেখানে সর্বত্র ক্লান্তি, অবসাদ ও মলিনতা। এই শূন্যতা অসহ্য হয়ে উঠল যখন মুকুন্দলাল আজও ফিরলেন না। নাগাল পাবার উপায় নেই বলেই নন্দরানীর ধৈর্যের বাঁধ হঠাৎ ফেটে খান্-খান্ হয়ে গেল।

 দেওয়ানজিকে ডাকিয়ে পরদার আড়াল থেকে বললেন, “কর্তাকে বলবেন, “বৃন্দাবনে মার কাছে আমাকে এখনই যেতে হচ্ছে। তাঁর শরীর ভালাে নেই।”

 দেওয়ানজি কিছুক্ষণ টাকে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “কর্তাকে জানিয়ে গেলেই ভালাে হত, মাঠাকরুন। আজকালের মধ্যে বাড়ি ফিরবেন খবর পেয়েছি।”

 “না, দেরি করতে পারব না।”

 নন্দরানীও খবর পেয়েছেন, আজকালের মধ্যেই ফেরবার কথা। সেই জন্যেই যাবার এত তাড়া। নিশ্চয় জানেন, অল্প একটু কান্নাকাটি-

১৮