পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

উঠোনের উপরের আকাশ থেকে লণ্ঠনজ্বালা অন্তঃপুরের পথ পর্যন্ত কেবলই চক্রপথে ঘুরছে। বারান্দায় পা মেলে দিয়ে দাসীরা উরুর উপরে প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি উঠে ঘােমটা টেনে দৌড় দিলে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল শ্যামাসুন্দরী, হাতে বাটাতে ছিল পান। মধুসূদন আপিস থেকে এলে নিয়মমতাে এই পান সে বাইরে পাঠিয়ে দিত। সবাই জানে, ঠিক মধুসূদনের রুচির মতাে পান শ্যামাসুন্দরীই সাজতে পারে; এইটে জানার মধ্যে আরও কিছু-একটা জানার ইশারা ছিল। সেই জোরে পথের মধ্যে শ্যামা মধুর সামনে বাটা খুলে ধরে বললে, “ঠাকুরপাে, তােমার পান সাজা আছে, নিয়ে যাও।” আগে হলে এই উপলক্ষে দুটো-একটা কথা হত, আর সেই কথায় অল্প একটু মধুর রসের আমেজও লাগত। আজ কী হল কে জানে পাছে দুর থেকেও শ্যামার ছোঁয়া লাগে সেইটে এড়িয়ে পান না নিয়ে মধুসূদন দ্রুত চলে গেল। শ্যামার বড়াে বড়াে চোখদুটো অভিমানে জ্বলে উঠল, তার পর ভেসে গেল অশ্রুজলের মােটা মােটা ফোঁটায়। অন্তর্যামী জানেন, শ্যামাসুন্দরী মধুসূদনকে ভালােবাসে।

 মধুসূদন ঘরে ঢুকতেই নবীন কুমুর পায়ের ধুলাে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “গুরুর কথা মনে রইল, খোঁজ করে দেখব।” দাদাকে বললে, “বউরানী গুরুর কাছ থেকে শাস্ত্র-উপদেশ শুনতে চান। আমাদের গুরুঠাকুর আছেন, কিন্তু—”

 মধুসুদন উত্তেজনার স্বরে বলে উঠল, “শাস্ত্র-উপদেশ! আচ্ছা সে দেখব এখন, তােমাকে কিছু করতে হবে না।”

 নবীন চলে গেল।

 মধুসূদন আজ সমস্ত পথ মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে এসেছিল, “বড়ােবউ, তুমি এসেছ, আমার ঘর আলাে হয়েছে।” এ-রকম ভাবের

১৯০