পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

 “আচ্ছা, থাক্ ওসব কথা। তোকে যেমন গান শেখাতুম, ইচ্ছে করছে তেমনি করে আজ তোকে শেখাই।”

 “ভাগ্যি শিখিয়েছিলে দাদা, ওতেই আমাকে বাঁচায়। কিন্তু আজ নয়, তুমি আগে একটু জোর পাও। আজ আমি বরঞ্চ তোমাকে একটা গান শোনাই।”

 দাদার শিয়রের কাছে বসে কুমু আস্তে আস্তে গাইতে লাগল,

“পিয়া ঘর আয়ে, সোহী পীতম পিয় পারে রে।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর,
চরণকমল বলিহার রে।”

 বিপ্রদাস চোখ বুজে শুনতে লাগল। গাইতে গাইতে কুমুর দুই চক্ষু ভরে উঠল এক অপরূপ দর্শনে। ভিতরের আকাশ আলো হয়ে উঠল। প্রিয়তম ঘরে এসেছেন, চরণকমল বুকের মধ্যে ছুঁতে পাচ্ছে। অত্যন্ত সত্য হয়ে উঠল অন্তরলোক, যেখানে মিলন ঘটে। গান গাইতে গাইতে ও সেইখানে পৌঁচেছে। “চরণকমল বলিহার রে”—সমস্ত জীবন ভরে দিলে সেই চরণকমল, অন্ত নেই তাঁর—সংসারে দুঃখ-অপমানের জায়গা রইল কোথায়? “পিয়া ঘর আয়ে” তার বেশি আর কী চাই। এই গান কোনোদিন যদি শেষ না নয় তা হলে তো চিরকালের মতো রক্ষা পেয়ে গেল কুমু।

 কিছু রুটি-টোস্ট আর এক পেয়ালা বার্লি গোকুল টিপাইএর উপর রেখে দিয়ে গেল। কুমু গান থামিয়ে বললে, “দাদা, কিছুদিন আগে মনে-মনে গুরু খুঁজছিলুম, আমার দরকার কী? তুমি যে আমাকে গানের মন্ত্র দিয়েছ।”

 “কুমু, আমাকে লজ্জা দিস নে। আমার মতো গুরু রাস্তায় ঘাটে মেলে, তারা অন্যকে যে-মন্ত্র দেয় নিজে তার মানেই জানে না। কুমু, কতদিন এখানে থাকতে পারবি ঠিক করে বল্ দেখি।”

২৩৫