পাতা:যোগাযোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
যোগাযোগ

স্থান পূর্বের চেয়ে আরও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কোথাও তার একটুও স্বচ্ছন্দতা নেই।

 এমন সময় একদিন সন্ধ্যেবেলায় শোবার ঘরে এসে দেখে, টেবিলের উপর দেয়ালে হেলানো কুমুর ফটোগ্রাফ। যে-বজ্র মাথায় পড়বে তারই বিদ্যুৎশিখা ওর চোখে এসে পড়ল। যে-মাছকে বঁড়শি বিঁধেছে তারই মত করে ওর বুকের ভিতরটা ধড়্‌ফড়্ ধড়্‌ফড়্‌ করতে লাগল। ইচ্ছা করে, ছবিটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, পারে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল, মুখ বিবর্ণ, দুই চোখে একটা দাহ, মুঠো দৃঢ় করে বন্ধ। একটা-কিছু ভাঙতে, একটা-কিছু ছিঁড়ে ফেলতে চায়। এ ঘরে থাকলে এখনই কিছু-একটা লোকসান করে ফেলবে এই ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আপনার ঘরে গিয়ে বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে চাদরখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেললে।

 রাত হয়ে এল। বাইরে থেকে বেহারা খবর দিলে, মহারাজ শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। বলবার শক্তি নেই যে যাব না। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে একটা বুটিদার ঢাকাই শাড়ি পরে গায়ে একটু গন্ধ মেখে গেল শোবার ঘরে। ছবিটা যাতে চোখে না পড়ে এই তার চেষ্টা। কিন্তু ঠিক সেই ছবিটার সামনেই বাতি— সমস্ত আলো যেন কারও দীপ্ত দৃষ্টির মতো ওই ছবিকে উদ্ভাসিত করে আছে। সমস্ত ঘরের মধ্যে ওই ছবিটিই সব চেয়ে দৃশ্যমান। শ্যামা নিয়মমতো পানের বাটা নিয়ে মধুসূদনকে পান দিলে, তার পরে পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যে-কোনো কারণেই হোক আজ মধুসূদন প্রসন্ন ছিল। বিলাতি দোকানের থেকে একটা রুপোর ফটোগ্রাফের ফ্রেম কিনে এনেছিল। গম্ভীরভাবে শ্যামাকে বললে, “এই নাও।” শ্যামাকে সমাদর করবার উপলক্ষ্যেও মধুসূদন মধুর রসের অবতারণায় যথেষ্ট কার্পণ্য করে।

২৭৮