পাতা:রংপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা (সপ্তম ভাগ).pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8 o রঙ্গপুর-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা পদ্মাপুরাণ ও দ্বিজবংশীদাস বঙ্গীয় সমাজ ও সাহিত্যে মনসাদেবীর প্রভাব সম্বন্ধে চিন্তা করিলে হৃদয় যুগপৎ বিস্ময় ও আনন্দে প্লাবিত হয়। জানিনা কে কোন সময় খাটি বাঙ্গালার হৃদয় ও মনকে মিশাইয়া তাহাতে ভাবের জল সেচন দ্বারা মনসার কাহিনী সজীব করিয়া মনোরম আলেখ্যে সর্বপ্রথম লোকলোচনের সাক্ষাং ধরিলেন। জানিনা গ্ৰন্থরচনার কত পূর্বে মনসার কাহিনীর ভয় ও বিস্ময়, ভক্তি ও সরলতা, বাঙ্গালীর কোমল হৃদয়ে উপ্ত হইয়া জাতীয় জীবনে অন্তঃসলিলা ফন্যানদীর প্রবাহের ন্যায় আনন্দ ধারায় বহিয়া যাইত। বাঙ্গালার খাটি স্বদেশী লোকসাহিত্যের সুন্দর বিকাশ এই মনসার কাহিনী জানিনা কবে কোন সুদূর অতীতের পুণ্য প্রস্রবণ হইতে জন্ম গ্রহণ করিয়া বাঙ্গালার অসংখ্য নরনারীর জীবন নূতন ভাবে উদ্দীপিত করিল। ক্ৰমে ক্ৰমে এই মনসার কাহিনী বাঙ্গালার প্রাচীন লিখিত সাহিত্যে স্থান পাইল । পদ্মাপুরাণ, মনসার পাঁচালী, প্রভৃতি দেশে প্রচলিত হইয়া উঠিল। সকল কাব্যেরই বর্ণনীয় বিষয় এক । আমরা ইহাকে “পদ্মাপুরাণ” এই সাধারণ নামের ভিতরে ধরিব । মনসাদেবীর অপর নাম পদ্মাবতী বা পদ্ম। তাই কাব্যের নাম পদ্মাপুরাণ | পদ্মাপুরাণ বাঙ্গালীর খাটি নিজস্ব সম্পত্তি। বাঙ্গালায়ই ইহার উৎপত্তি ও স্থিতি । বাঙ্গালীয় সমাজের ধৰ্ম্মতত্ত্ব, দেবদেবী তত্ত্ব, প্রভৃতি পদ্মাপুরাণে প্ৰকাশ পাইয়াছে। পদ্মাপুরাণ বাঙ্গালীর হৃদয়ের কথা। ইহা বাঙ্গালীর সুখ দুঃখের কাহিনী। তাই বাঙ্গালীর নিকট পদ্মাপুরাণ আদৃত। শিশু যথন রূপকথা শুনে, তখন সে মুগ্ধচিত্তে আদি হইতে অন্ত পৰ্য্যন্ত অক্লান্তভাবে শুনিয়া যায়। তাহার কল্পনাময় হৃদয়ে রূপকথা সজীব মূৰ্ত্তি ধারণ করে। সেই পরীর দেশ, সেই সোনার পাখী, সমস্ত তাহার চক্ষে বাস্তব বলিয়া প্ৰতীত হয় । কই, কোন দিন ত শিশু শ্রোতা বর্ণনীয় বিষয়ের ঘটনাবলী সত্য কিনা জানিবার জন্য বক্তকে প্রশ্ন করে নাই। শিশুর যাহাতে আনন্দ হয়, তাহাই তাহার নিকট সত্য বলিয়া অনুভূত হয়। শিশুর পক্ষে যাহা খাটে, সমাজের শৈশব অবস্থার পক্ষে তাহা ও প্রযোজ্য। পদ্মাপুরাণের কাহিনী রূপকথার মত। মৰ্ত্তের মানুষ, আমাদেরই বাঙ্গালী মেয়ে, কলার মানদাসে চড়িয়া মৃত পতি বুকে লইয়া, সাগর সঙ্গম হইয়া, দেবপুরে গিয়া তথায় নৃত্য করিয়া দেবতাদিগের অনু গ্রহে মৃত পতির ও মৃত ভাসুরদিগের পুনর্জীবন লাভ করাইল। মরা মানুষ কি বঁাচে ? এই প্রশ্ন কি কেহ করিতে সাহস পাইয়াছে ? দেবানু গ্রহে সকলই সম্ভব। ভক্ত বাঙ্গালীর সরল হৃদয় কিছুই অবিশ্বাস করিতে পারিত না। দেবতাদিগকে পূজা অৰ্চনা দ্বারা সন্তুষ্ট রাখিতে হয়, নতুবা পদে পদে মানুষের বিপদ। দেবতার সহিত দ্বন্দ্ব করিয়া কেহ পারে না। সতী স্ত্রীর অসাধ্য কিছুই নাই। ইত্যাদি কত তত্ত্ব পদ্মাপুরাণে প্ৰকটিত হইয়াছে। এই সমস্ত বাঙ্গালী সমাজের হৃদয়ের কথা । তাই পদ্মাপুরাণের এত আদর। পদ্মাপুরাণ সাহিত্য ও কাব্য। ভাবের মিলনে পদ্মাপুরাণ সাহিতা, রসের সমবায়ে ইহা কাব্য। একাধারে পদ্মাপুরাণ লোকসাহিত্য ও ধৰ্ম্ম কাব্য।