পাতা:রক্তকরবী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©Ꮈ$ করবার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও দন্তসফুট করতে পারবে না। আপনারা প্রবীণ। চশমা বাগিয়ে পালাটার ভিতর থেকে একটা গুঢ় অর্থ খুঁটিয়ে বের করবার চেষ্টা করবেন, আমার নিবেদন, যেটা গুঢ় তাকে প্রকাশ্য করলেই তার সার্থকতা চলে যায়। হৃৎপিণ্ডটা পাঁজরের আড়ালে থেকেই কাজ করে । তাকে বের ক’রে ফেলে তার কার্যপ্রণালী অন্বেষণ করতে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। দশমুণ্ড বিশহাতওয়ালা রাবণের স্বৰ্ণলঙ্কায় সামান্য একটা বন্য বানর ল্যাজে ক'রে আগুন লাগায় এই কাহিনীটি যদি কবিগুরু আজ আপনাদের এই সভায় উপস্থিত করতেন তাহলে তার গুঢ় অর্থ নিয়ে আপনাদের চণ্ডীমণ্ডপে একটা কলরব উঠত। সন্দেহ করতেন কোনো একটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধি-ব্যবস্থাকে বুঝি বিদ্রুপ করা হচ্ছে। অথচ শত শত বছর ধরে স্বভাব-সন্দিগ্ধ লোকেরাও রামায়ণের প্রকাশ্যে যে-রস আছে তাই ভোগ করে এলেন— গোপনে যে-অর্থ আছে তার ঝুঁটি ধীরে টানাটানি করলেন না। আমার পালায় একটি রাজা আছে। আধুনিক যুগে তার একটার বেশি মুণ্ড ও দুটোর বেশি হাত দিতে সাহস হল না। আদি কবির মতো ভরসা থাকলে দিতেম, বৈজ্ঞানিক শক্তিতে মানুষের হাত পা মুণ্ড অদৃশ্যভাবে বেড়ে গেছে। আমার পালার রাজা যে সেই শক্তিবাহুল্যের যোগেই গ্রহণ করেন গ্রাস করেন নাটকে এমন আভাস আছে। ত্রেতাযুগের বহুসংগ্রহী বহুগ্রাসী রাবণ বিদ্যুৎ বজ্রধারী দেবতাদের আপন প্রাসাদ-দ্বারে শঙ্খলিত করে তাদের দ্বারা কাজ আদায় করত। তার প্রতাপ চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকতে পারত। কিন্তু তার দেবদ্রোহী সমৃদ্ধির মাঝখানে হঠাৎ একটি মানবকন্যা এসে দাঁড়ালেন, অমনি ধর্ম জেগে উঠলেন। মূঢ় নিরস্ত্র বানরকে দিয়ে তিনি রাক্ষসকে পরাস্ত করলেন। আমার নাটকে ঠিক এমনটি ঘটে নি কিন্তু এর মধ্যেও মানবকন্যার আবির্ভাব আছে। তা ছাড়া কলিযুগের রাক্ষসের সঙ্গে কলিযুগের বানরের যুদ্ধ ঘটবে এমনো একটা সূচনা আছে। আদি কবির সাতকাণ্ডে স্থানাভাব ছিল না এই কারণে লঙ্কাপুরীতে তিনি রাবণ ও বিভীষণকে স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছিলেন । কিন্তু আভাস দিয়েছিলেন যে তারা একই, তারা সহোদর ভাই । একই নীড়ে পাপ ও সেই পাপের আঘাত লালিত হয়েছে । আমার স্বল্পায়তন নাটকে রাবণের বর্তমান প্রতিনিধিটি একদেহেই রাবণ ও বিভীষণ । সে আপনাকেই আপনি পরাস্ত করে । বাল্মীকির রামায়ণকে ভক্ত পাঠকেরা সত্যমূলক বলে স্বীকার করেন। আমার পালাটিকে যারা শ্রদ্ধা করে শুনবেন তাঁরা জানবেন এটিও সত্যমূলক । ঐতিহাসিকের উপরে প্রমাণের ভার দিলে ঠকবেন। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, কবির জ্ঞান বিশ্বাস মতে এটি সত্য । ঘটনাস্থানটির প্রকৃত নাম নিয়ে ভৌগোলিকদের কাছে মতের ঐক্য প্রত্যাশা করা মিছে। স্বর্ণলঙ্কা যে সিংহলে তা নিয়েও আজ কত কথাই উঠেছে। বস্তুত পৃথিবীর নানা স্থানে নানা স্তরেই স্বৰ্ণলঙ্কার চিহ্ন পাওয়া যায়। কবিগুরু যে সেই অনির্দিষ্ট অথচ সুপরিনির্দিষ্ট স্বৰ্ণলঙ্কার সংবাদ পেয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সে স্বর্ণলঙ্কা যদি খনিজ সোনাতেই বিশেষ একটা স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকত তাহলে ল্যাজের আগুনে ভস্ম না হয়ে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠত। স্বৰ্ণলঙ্কার মতোই আমার পালার ঘটনাস্থানের একটি ডাকনাম আছে। তাকে কবি যক্ষপুরী বলে জানে। তার কারণ এ নয় যে সেখানে পৌরাণিক কুবেরের স্বর্ণ-সিংহাসন । যক্ষের ধন মাটির নীচে পোতা আছে। এখানকার