পাতা:রক্তকরবী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৮৯ এই নাট্যব্যাপার চলেছে “যক্ষপুরী"তে যেখানে মাটির তলায় কবর দেওয়া থাকে যক্ষের ধন,– পাতালের কাছাকাছি একটা জায়গায়। যক্ষপুরের ভারবাহীর দল— মাটির তলাকার সোনা তোলার কাজে দিনরাত নিযুক্ত— খুঁড়ে তুলছে মাটি, কেটে চলেছে সুড়ঙ্গ, বহে আনছে কত কত সোনা তাল তাল অবিরাম। এখানকার “মালিক” যে, সে আছে অষ্টপ্রহর, অসংখ্য মানুষের সুখদুঃখ থেকে দূরে, একটা অত্যন্ত জটিল জালের আবরণে ভীষণ তার অদৃশ্য শক্তি নিয়ে প্রচ্ছন্ন। প্রকৃতির বক্ষ থেকে মানুষের প্রাণ থেকে শক্তি শোষণ করে নিয়ে স্ফীত হবার যাদু সে জানে,– তাই নিয়ে অমানুষিক নিৰ্ম্মমতার নানা পরীক্ষায় সে নিযুক্ত। তার পরীক্ষাশালায় যে প্রবেশ করে সে বেরিয়ে আসে কঙ্কালসার হয়ে । তার অস্তিত্ব হয় ছায়ার মতো নিঃস্বত্ব । বিরাট এই জালের তৈরি বেড়া এর বাহিরে খোদাইকরদের কাটা নানা কালো কালো খানাখন্দগুলোই ক্ষুধাৰ্ত্ত দানবের কবলের মতো পড়ে দৃষ্টিপথে। এইখানে তপ্ত ফাগুনের প্রখর আলোয় কোনো এক প্রমত্ত বসন্তদিন ফুটিয়ে তুললে একটি ‘রক্তকরবী” । আনন্দহীন কৰ্ম্মের আবর্জনার একধারে মূল্যহীন আনন্দের ইসারা জানালে সেই ফুল! ‘বিশু পাগল সে আগলভাঙা প্রাণ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই রক্তকরবীকে ঘিরে— মরুভূমির খোলা বাতাস যেন সে ! কন্মের শেষে যক্ষপুরে ওঠে "চাদ", শাস্ত তার দৃষ্টি— জাগায় নেশার অতৃপ্তি কারিগরদের মনে, মাতলামির অট্টহাস্যের ধ্বনি জাগে, অশান্ত রাত্রির পারে তলিয়ে যায় চাঁদ মাতালের হাতে ভাঙাচোরা একটা স্বর্ণপাত্রের মতো । 3 지 যক্ষপুরীর মানুষধরা ফাঁদে কখন ধরা পড়েছে নন্দিনী। ছিল সে “রঞ্জনের” নৰ্ম্মসখী, প্রেমের নন্দনবনে, এখানে এসেছে প্রাণগ্রাসী পাতালপুরীর হা-করা গহবরের প্রদোষান্ধকারে। “রঞ্জনের” বাঁশির ডাকের সুর আসে নন্দিনীর চোখে, তার হাসিতে, তার চলায় বলায় চঞ্চল হয়ে ওঠে যক্ষপুরীর বাহনের দল । তার কাছে ছুটে আসে “কিশোর”, না-দেখা বনের রক্তকরবী ফুলের সন্ধান দেয় নন্দিনীকে । ক্ষণে ক্ষণে ব্যাঘাত হয় অধ্যাপনায়, ওর কাছে কাছে ঘুরে বেড়ান অধ্যাপক’, ইনি শক্তিতত্বের আলোচনা করেছেন অনেককাল, এখন নন্দিনীকে দেখে অবধি আনন্দরহস্যের সীমা পান না। তার নিরঞ্জন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে রক্তকরবীর রঙের অঞ্জন লাগল। রঞ্জনের বঁশি ডাকে থেকে থেকে নন্দিনীকে কাজের ভিড়ের মধ্যেও । এই খবরটা জানে মালিক ;– আর সে এও জানে যে, যে সোনা সে পায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ দেউলে ক’রে সেই সোনা দিয়ে সে আনন্দ পায় না কণামাত্র । তাই সে ঐশ্বৰ্য্যের পিঞ্জরে গর্জাতে থাকে বন্ধ্যা সম্পদের নিফলতায়। রঞ্জন আর নন্দিনীর মাঝে সে সৃষ্টি করতে চায় প্রচণ্ড বিচ্ছেদ । পিপাসার্ভ নীরস কষ্ঠের নিরানন্দ অট্টহাসি হাসে সে আপন জটিল জালের আড়ালে বসে– নন্দিনীর পরে তার নিগুঢ় টান নিৰ্ম্মম ঈর্ষায় সাংঘাতিক হয়ে ওঠে । দ্বিতীয়— যক্ষপুরীতে ধ্বজা পূজার উৎসব লেগেছে– কৰ্ম্মক্লান্ত দিনের মাঝে একটুখানি অবসর, যার অবসান হল বীভৎস উল্লাস আর নিদারুণ ধ্বস্তাধবস্তি কোস্তাকুস্তির প্রাণান্তকর দৃশ্যে !