এই অবস্থারই একটি চিত্র গোরা-চরিত্রের মধ্যে নিঃসন্দেহ দেখিতে পাইয়াছেন। কিন্তু গোরার ন্যায় কবি রবীন্দ্রনাথকেও এ অবস্থার ভিতর দিয়া যাইতে হইয়াছিল এবং যাইবার প্রয়োজনও ছিল। প্রয়োজন ছিল বলিতেছি কেন তাহার কারণ আছে। আমাদের দেশের আধুনিক কালে সকলের চেয়ে বড় সমস্যাটা কী তাহা আলোচনা করিলেই আমার এরূপ কথা বলিবার তাৎপর্য নির্ণীত হইবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার আঘাতে আমাদের এই সুপ্ত দেশ যখন জাগিয়া উঠিল, তখন আমাদের প্রাচীন সমাজ আচারবিচারের সহস্র বেষ্টন তুলিয়া বিশ্ব হইতে আমাদের চিত্তকে অবরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে ইহাই আমরা অনুভব করিলাম। আমাদের দেশের ইতিহাসের যে বিপুল ধারা বিচিত্র জাতির বিচিত্র আদর্শের সমন্বয়ে পরিপুষ্ট হইয়া এক যুগ হইতে অন্য যুগে এতাবৎকাল সমান বেগে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছিল, তাহার সেই স্রোত এক সময়ে বন্ধ হইলে আমরা তাহার পূর্ব-ইতিহাসের কোনো সংবাদই পাইলাম না— জীর্ণ লোকাচারের শৈবালবন্ধনে তাহার অচল অসাড় জীবনহীন ভাব দেখিয়া আমরা ভাবিলাম যে, আমাদের দেশে প্রাণের বুঝি চিরকালই এমনিতর অভাব। দেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকিল না।
সুতরাং আমরা পশ্চিমের সভ্যতার দ্বারা অভিভূত হইয়া সমাজকে ভাঙিলাম। আমরা বলিলাম, ব্যক্তির স্বাধীনতা দিতে হইবে— ব্যক্তি যাহা জ্ঞানপূর্বক বুঝিবে তাহাই সে আচরণ করিবে— সমাজ তাহাকে শাসন করিলে সে শাসন তাহার অস্বীকার করাই কর্তব্য।
ইউরোপে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আছে বটে, কিন্তু তাহাকে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের সূত্রে সকলের ঐক্য থাকার জন্য সেখানে মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ দাঁড়ায় না, মানুষে মানুষে সকল বিষয়েই সম্মিলিত
১০২