লোক যে তাহার সঙ্গে সায় দিতেও অক্ষম, সে কথা এই শ্রেণীর ভাবুক চিন্তার মধ্যেই আনেন না। ক্রমাগত বাস্তবক্ষেত্রে তাই এই ভাবুকদের আঘাত খাইতে হয় এবং ক্রমে তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, বাস্তবের সঙ্গে কারবার করিতে হইলে বিকারকে মিথ্যাকে কদাচারকে মন হইতে আড়াল করিয়া রাখিলে চলে না— তাহাদের কঠিন আঘাত দেওয়াই দরকার। প্রকাণ্ড একটি বিশ্বসত্যের মধ্যে সমস্ত কর্মকে অনুষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠানকে আবৃত করিয়া না দেখিলে অসত্যে সত্যে, অনিত্যে নিত্যে এমন গোল পাকাইয়া থাকে যে, কাজের পথে এক পা’ও অগ্রসর হওয়া যায় না।
গোরাকে বাস্তবক্ষেত্রে ক্রমাগত টানিয়া গ্রামের ভিতরে ঘুরাইয়া নানা উপায়ে তাহার সুকঠিন ভাবুকতার দুর্গটিকে কবির সজোরে ভাঙিতে হইয়াছে— সে যে এমন একটি ভাবের দ্বারা আবিষ্ট হইয়া আছে, যাহা দেশের কাহারও মধ্যে নাই, তাহার নিজের জন্মবৃত্তান্তই চোখে আঙুল দিয়া তাহাই সর্বশেষে তাহাকে দেখাইয়া দিল। তখন সে ভারতবর্ষকে যে উদার সত্যদৃষ্টিতে দেখিল তাহা বিশেষভাবে হিন্দুর ভারতবর্ষ নহে, কিন্তু সমস্ত মানবজাতির মহাসম্মিলনক্ষেত্র।
রবীন্দ্রনাথকেও এক সময়ে খুব উগ্র স্বাদেশিক উত্তেজনা হইতে সরিয়া আসিয়া আবার দেশকে তাহার যথার্থ স্বরূপে এবং আপনার সাধনাকে তাহার যথার্থ সত্যে দেখিতে হইয়াছিল।
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। বঙ্গদর্শন-সম্পাদনের দ্বিতীয় বৎসরে ৭ই অগ্রহায়ণ ১৩০৯ সালে কবির স্ত্রীবিয়োগ হয়।
এ আঘাত তাঁহার চিত্তকে খুব কঠিন ত্যাগের দিকে, আত্মোৎসর্গের দিকেই অগ্রসর করিয়া দিল। তখন হইতেই সংসার হইতে তিনি একপ্রকার বিচ্ছিন্ন। আপনার শক্তি সামর্থ্য অর্থ সময় সমস্তের দ্বারা তাঁহার ত্যাগের তপস্যাকে পূর্ণ করিতে লাগিলেন।
১০৬