কবি যে তাঁহার স্বাদেশিকতার অবস্থায় হিন্দুসমাজের গুণকীর্তন করিতেন তাহার একটা কারণ এই যে, আমাদের দেশের সমস্ত সম্বন্ধের মধ্যে একটা অনন্তের রহস্যবোধ আছে। অনন্ত যে মুহূর্তে মুহূর্তে সমস্ত সৌন্দর্যকে সমস্ত মানবসম্বন্ধকে রন্ধ্র, করিয়া আপনার অপরূপ প্রকাশকে ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছেন, হিন্দুর চিত্ত সে কথা গভীরভাবে স্বীকার করিয়া থাকে। স্বামীকে তাই দেবতারূপে পূজা করা হিন্দু সতী স্ত্রীর পক্ষে স্বাভাবিক, পত্নীর মধ্যেও হিন্দু স্বামী জগতের সৌন্দর্য ও কল্যাণের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর প্রতিমা সন্দর্শন করিয়া থাকেন। পুত্রের মধ্যে গোপাল রূপে ভগবান পিতার সঙ্গে লীলা করেন, কন্যার মধ্যে তাঁহার অন্নপূর্ণা মাতৃমুর্তি প্রত্যক্ষ হইয়া উঠে। কোনো সম্বন্ধই প্রয়োজনের সম্বন্ধ নয়, সে অনাদিকালের সম্বন্ধ, সে জন্মজন্মান্তরের সম্বন্ধ এবং তাহারই মধ্যে দেবতার প্রকাশ— হিন্দুর অবতারবাদী ভক্তিপ্রবণ হৃদয় এ কথা না বলিয়া থাকিতে পারে না। বৈষ্ণবধর্মের ভিতরকার এইটিই আসল কথা— ভগবানকে নানা রসে নানা সম্বন্ধে উপলব্ধি করা। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটি ইহার অনতিকাল পরেই লিখিত— তাহার মধ্যে এই দিকটাই দেখানো হইয়াছে। সেই উপন্যাসের নায়িকা কমলা যখন জানিল যে রমেশ তাহার স্বামী নহে, তখন এক মুহূর্তেই তাহার রমেশের সঙ্গে সম্বন্ধ ঘুচিয়া গেল— সে যে ব্যক্তিকে ভালো বাসে নাই, স্বামীকে ভালো বাসিয়াছে— সেই স্বামী যখন ব্যক্তিবিশেষ নয় তখন তাহার প্রতি হৃদয়ের কোনো অনুরাগ তাহার থাকিতেই পারে না। তার পর দাসীবেশে যখন সে আপন স্বামীর আলয়ে ছিল তখনও কেবলমাত্র গোপন পূজার দ্বারা সে আপনাকে চরিতার্থ জ্ঞান করিয়াছে, আর কিছুই তাহার পক্ষে প্রয়োজন হয় নাই। হিন্দুভাবের খুব গভীরতার মধ্যে প্রবেশ না করিলে এ রকমের জিনিস কবির হাত হইতে বাহির হইতেই পারিত না।
১০৮