পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邻致@瓦 ○ じ(? আমার চোখের সামনে কোনো মূর্তি ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে আমি একটি হৃদয়ের রূপ দেখিতে লাগিলাম। সে যেন এই তারাময়ী রাত্রির মতো, আবৃত করিয়া ধরে কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারা যায় না। ওগো সুর, অচেনা কণ্ঠের সুর, এক নিমেষে তুমি যে আমার চিরপরিচয়ের আসনটির উপরে আসিয়া বসিয়াছ। কী আশ্চর্য পরিপূর্ণ তুমি- চঞ্চল কালের ক্ষুব্ধ হৃদয়ের উপরে ফুলটির মতো ফুটিয়াছ অথচ তার ঢেউ লাগিয়া একটি পাপড়িও টলে নাই, অপরিমেয় কোমলতায় এতটুকু দাগ পড়ে क्राष्ट्रि | গাড়ি লোহার। মৃদঙ্গ তাল দিতে দিতে চলিল ; আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম । তাহার একটিমাত্র ধুয়া- ‘গাড়িতে জায়গা আছে।” আছে কি, জায়গা আছে কি । জায়গা যে পাওয়া যায় না, কেউ যে কাকেও চেনে না । অথচ সেই না-চেনাটুকু যে কুয়াশামাত্র, সে যে মায়া, সেটা ছিন্ন হইলেই যে চেনার আর অন্ত নাই । ওগো সুধাময় সুর, যে হৃদয়ের অপরূপ রূপ তুমি সে কি আমার চিরকালের চেনা নয় । জায়গা আছে, আছে- শীঘ্ৰ আসিতে ডাকিয়াছ, শীঘ্রই আসিয়াছি, এক নিমেষও দেরি করি নাই । রাত্রে ভালো করিয়া ঘুম হইল না । প্রায় প্রতি স্টেশনেই একবার করিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিলাম, ভয় হইতে লাগিল, যাহাকে দেখা হইল না সে পাছে রাত্রেই নামিয়া যায় । পরদিন সকালে একটা বড়ো স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইবে । আমাদের ফাস্টক্লাসের টিকিটমনে আশা ছিল, ভিড় হইবে না। নামিয়া দেখি, প্ল্যাটফর্মে সাহেবদের আর্দালি-দল আসবাবপত্র লইয়া গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কোন-এক ফৌজের বড়ো জেনারেল-সাহেব ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছেন । দুই-তিন মিনিট পরেই গাড়ি আসিল । বুঝিলাম, ফাস্টক্লাসের আশা ত্যাগ করিতে হইবে । মাকে লইয়া কোন গাড়িতে উঠি সে এক বিষম ভাবনায় পড়িলাম। সব গাড়িতেই ভিড় । দ্বারে দ্বারে উকি মারিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। এমন সময় সেকেন্ড ক্লাসের গাড়ি হইতে একটি মেয়ে আমার মাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাদের গাড়িতে আসুন-না- এখানে জায়গা আছে।” আমি তাে চমকিয়া উঠিলাম। সেই আশ্চর্যমধুর কণ্ঠ এবং সেই গানেরই ধুয়া— ‘জায়গা আছে ? ক্ষণমাত্ৰ বিলম্ব না করিয়া মাকে লইয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলাম। জিনিসপত্র তুলিবার প্রায় সময় ছিল না। আমার মতো অক্ষম দুনিয়ায় নাই। সেই মেয়েটিই কুলিদের হাত হইতে তাড়াতাড়ি চলতি গাড়িতে আমাদের বিছানাপত্ৰ টানিয়া লইল । আমার একটা ফোটােগ্রাফ তুলিবার ক্যামেরা স্টেশনেই পড়িয়া রহিল- গ্রাহ্যই করিলাম না । তার পরে— কী লিখিব জানি না । আমার মনের মধ্যে একটি অখণ্ড আনন্দের ছবি আছে, তাহাকে কোথায় শুরু করিব, কোথায় শেষ করিব ? বসিয়া বসিয়া বাক্যের পর বাক্য যোজনা করিতে ইচ্ছা! করে না । এবার সেই সুরটিকে চোখে দেখিলাম । তখনো তাহাকে সুর বলিয়াই মনে হইল। মায়ের মুখের দিকে চাহিলাম ; দেখিলাম, তার চোখে পলক পড়িতেছে না । মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হইবে, কিন্তু নবযৌবন ইহার দেহে মনে কোথাও যেন একটুও ভার চাপাইয়া দেয় নাই। ইহার গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, ইহার কোনো জায়গায় কিছু জড়িমা নাই। আমি দেখিতেছি, বিস্তারিত করিয়া কিছু বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। এমন-কি, সে যে কী রঙের কাপড় কেমন করিয়া পরিয়াছিল তাহাও ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এটা খুব সত্য যে, তার বেশে ভূষায় এমন কিছুই ছিল না যেটা তাহাকে ছাড়াইয়া বিশেষ করিয়া চোখে পড়িতে পারে। সে নিজের চারিদিকের সকলের চেয়ে অধিক- রজনীগন্ধর শুভ্ৰ মঞ্জরীর মতো সরল বৃন্তটির উপরে দাড়াইয়া, যে গাছে ফুটিয়াছে সে গাছকে সে একেবারে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে দুটি-তিনটি ছোটাে ছোটাে মেয়ে ছিল, তাহাদিগকে লইয়া তাহার হাসি এবং কথার আর অন্ত ছিল না । আমি হাতে একখানা বই লইয়া সেদিকে কান পাতিয়া রাখিয়াছিলাম। যেটুকু কানে আসিতেছিল সে তো সমস্তই ছেলেমানুষদের সঙ্গে ছেলেমানুযি কথা । তাহার বিশেষত্ব এই যে, তাহার মধ্যে বয়সের তফাত