পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O রবীন্দ্র-রচনাবলী 3 (ی আমাদের নায়কের তো এই দশা ; নায়িকা যোড়শী তখন সবেমাত্র ত্রয়োদশী । বাড়িতে শেষ পর্যন্ত সবাই তাকে খুকি। বলিয়া ডাকিত, শ্বশুরবাড়িতেও সে আপনার এই চিরশৈশবের খ্যাতি লইয়া আসিয়াছিল, এইজন্য তার সামনেই বরদার চরিত্র-সমালোচনায় বাড়ির দাসীগুলোর পর্যন্ত বাধিত না । শাশুড়ি ছিলেন চিরারুগণা- কর্তার কোনো বিধানের উপরে কোনো কথা বলিবার শক্তি র্তার ছিল না, এমন-কি, মনে করিতেও তার ভয় করিত । পিসশাশুড়ির ভাষা ছিল খুব প্রখর ; বরদাকে লইয়া তিনি খুব শক্ত শক্ত কথা খুব চোখা চোখা করিয়া বলিতেন । তার বিশেষ একটু কারণ ছিল । পিতামহদের আমল হইতে কৌলীন্যের অপদেবতার কাছে বংশের মেয়েদের বলি দেওয়া, এ বাড়ির একটা প্ৰথা । এই পিসি যার ভাগে পড়িয়াছিলেন সে একটা প্ৰচণ্ড গাজাখের । তার গুণের মধ্যে এই যে, সে বেশিদিন বঁাচে নাই। তাই আদর করিয়া ষোড়শীকে তিনি যখন মুক্তাহারের সঙ্গে তুলনা করিতেন তখন অন্তর্যামী বুঝিতেন, ব্যর্থ মুক্তাহারের জন্য যে-আক্ষেপ সে একা ষোড়শীকে লইয়া নয় । এ ক্ষেত্রে মুক্তাহারের যে বেদনাবোধ আছে, সে কথা সকলে ভুলিয়াছিল । পিসি বলিতেন, ‘দাদা কেন যে এত মাস্টার-পণ্ডিতের পিছনে খরচ করেন তা তো বুঝি নে । লিখে পড়ে দিতে পারি, বরদা কখনোই পাস করতে পারবে না ।” পরিবে না। এ বিশ্বাস ষোড়শীরও ছিল, কিন্তু সে একমনে কামনা করিত, যেন কোনো গতিকে পাস করিয়া বরদা অন্তত পিসির মুখের বঁাজটা মারিয়া দেয় । বরদা প্রথমবার ফেল করিবার পর মাখন যখন দ্বিতীয়বার মাস্টারের ব্যুহ বাধিবার চেষ্টায় লাগিলেন, পিসি বলিলেন, “ধন্য বলি দাদাকে ! মানুষ ঠেকেও তো শেখে ।” তখন ষোড়শী দিনরাত কেবল এই অসম্ভব-ভাবনা ভাবিতে লাগিল, বরদা এবার যেন হঠাৎ নিজের আশ্চর্য গোপন শক্তি প্ৰকাশ করিয়া অবিশ্বাসী জগৎটাকে স্তম্ভিত করিয়া দেয় ; সে যেন প্ৰথম শ্রেণীতে সব-প্ৰথমের চেয়েও আরো আরো আরো অনেক বড়ো হইয়া পাস করে- এত বড়ো যে স্বয়ং লাটসাহেব সওয়ার পাঠাইয়া দেখা করিবার জন্য তাহাকে তলব করেন । এমন সময়ে কবিরাজের অব্যৰ্থ বড়িটা ঠিক পরীক্ষাদিনের মাথার উপর যুদ্ধের বোমার মতো আসিয়া পড়িল । সেটাও মন্দের ভালো হইত যদি লোকে সন্দেহ না করিত । পিসি বলিলেন, ‘ ছেলের এদিকে বুদ্ধি নেই, ওদিকে আছে।’ লাটসাহেবের তলব পড়িল না । ষোড়শী মাথা হেঁট করিয়া লোকের হাসাহসি সহ্য করিল । সময়োচিত জোলাপের প্রহসনটায় তার মনেও যে সন্দেহ হয় নাই, এমন কথা বলিতে পারি না । এমন সময় বরদা ফেরার হইল । ষোড়শী বড়ো আশা করিয়াছিল, অন্তত এই ঘটনাকেও বাড়ির লোকে দুর্ঘটনা জ্ঞান করিয়া অনুতাপ পরিতাপ করিবে । কিন্তু তাহাদের সংসার বরদার চলিয়া যাওটাকেও পুরা দাম দিল না । সবাই বলিল, “এই দেখো-না, এলো ব’লে ?” ষোড়শী মনে মনে বলিতে লাগিল, “কখখনো না ! ঠাকুর, লোকের কথা মিথ্যা হােক ! বাড়ির লোককে যেন হায়-হায় করতে হয় ?” এইবার বিধাতা ষোড়শীকে বর দিলেন ; তার কামনা সফল হইল । এক মাস গেল, বরদার দেখা নাই ; কিন্তু তবু কারও মুখে কোনো উদবেগের চিহ্ন দেখা যায় না। দুই মাস গেল, তখন মাখনের মনটা একটু চঞ্চল হইয়াছে, কিন্তু বাহিরে সেটা কিছুই প্ৰকাশ করিলেন না । বউমার সঙ্গে চোখাচোখি হইলে তার মুখে যদি-বা বিষাদের মেঘ-সঞ্চার দেখা যায়, পিসির মুখ একেবারে জ্যৈষ্ঠমাসের অনাবৃষ্টির আকাশ বলিলেই হয় । কাজেই সদর দরজার কাছে একটা মানুষ দেখিলেই ষোড়শী চমকিয় ওঠে ; আশঙ্কা, পাছে তার স্বামী ফিরিয়া আসে ! এমনি করিয়া যখন তৃতীয় মাস কাটিল, তখন ছেলেটা বাড়ির সকলকে মিথ্যা উদবিগ্ন করিতেছে বলিয়া পিসি নালিশ শুরু করিলেন । এও ভালো, অবজ্ঞার চেয়ে রাগ ভালো । পরিবারের মধ্যে ক্রমে ভয় ও দুঃখ ঘনাইয়া আসিতে লাগিল । খোজ করিতে করিতে ক্রমে এক বছর যখন কাটিল তখন, মাখন যে বরদার প্রতি অনাবশ্যক কঠোরাচরণ করিয়াছেন, সে কথা পিসিও বলিতে শুরু করিলেন । দুই বছর যখন গেল তখন পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলিতে লাগিল, বরদার পড়াশুনায় মন ছিল না বটে, কিন্তু মানুষটি বড়ো ভালো ছিল । বরদার অদর্শনকাল যতই দীর্ঘ হইল ততই, তার স্বভাব যে অত্যন্ত নির্মল ছিল, এমন-কি, সে যে তামাকটা পর্যন্ত খাইত না, এই অন্ধ