পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ortr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী এতদিন তো শব্দসাগর মন্থন করে ডিগ্রিরত্ন পাওয়া গেল, এবার অর্থসাগর-মন্থনের পালা । বাবা তার বড়ো বড়ো পেট্রন সাহেবদের স্মরণ করতে গিয়ে দেখলেন, তার সব চেয়ে বড়ো সহায় যিনি তিনি পরলোকে, তার চেয়ে যিনি কিছু কম তিনি পেন্সন নিয়ে বিলেতে, যিনি আরো কমজোরী তিনি পাঞ্জাবে বদলি হয়েছেন, আর যিনি বাংলাদেশে বাকি আছেন তিনি অধিকাংশ উমেদারকেই উপক্ৰমণিকায় আশ্বাস দেন। কিন্তু উপসংহারে সেটা সংহরণ করেন । আমার পিতামহ যখন ডিপুটি ছিলেন তখন মুরুবিবর বাজার এমন কষা ছিল না। তাই তখন চাকরি থেকে পেন্সন এবং পেন্সন থেকে চাকরি একই বংশে খেয়া-পারাপারের মতো চলত। এখন দিন খারাপ, তাই বাবা যখন উদবিগ্ন হয়ে ভাবছিলেন যে, তার বংশধর গভমেন্ট আপিসের উচ্চ খাচা থেকে সওদাগরি আপিসের নিম্ন দাড়ে অবতরণ করবে: কি না, এমন সময় এক ধনী ব্ৰাহ্মণের একমাত্র কন্যা তার নোটিশে এল । ব্ৰাহ্মণটি কনট্র্যাক্টর, তার অর্থাগমের পথটি প্রকাশ্য ভূতলের চেয়ে অদৃশ্য রসাতলের দিক দিয়েই প্রশস্ত ছিল । তিনি সে সময়ে বড়োদিন উপলক্ষে কমলা লেবু ও অন্যান্য উপহারসামগ্ৰী যথাযোগ্য পাত্রে বিতরণ করতে ব্যস্ত ছিলেন, এমন সময়ে তার পাড়ায় আমার অভু্যদয় হল । বাবার বাসা ছিল তার বাড়ির সামনেই, মাঝে ছিল এক রাস্তা । বলা বাহুল্য, ডেপুটির এম. এ. পাস-করা ছেলে কন্যাদায়িকের পক্ষে খুব ‘প্ৰাংশুলভ্য ফল ।” এইজন্যে কনট্র্যাক্টর বাবু আমার প্রতি উদ্বাহু হয়ে উঠেছিলেন। তার বাহু আধুলিলন্বিত ছিল সে পরিচয় পূর্বেই দিয়েছি- অন্তত সে বাহু ডেপুটিবাবুর হৃদয় পর্যন্ত অতি অনায়াসে পৌছল। কিন্তু, আমার হৃদয়টা তখন আরো অনেক উপরে ছিল । কারণ, আমার বয়স তখন কুড়ি পেরোয়-পেরোয় ; তখন খাটি স্ত্রীরত্ব ছাড়া অন্য কোনো রত্নের প্ৰতি আমার লোভ ছিল না। শুধু তাই নয়, তখনো ভাবুকতার দীপ্তি আমার মনে উজ্জ্বল। অর্থাৎ, সহধর্মিণী শব্দের যে-অর্থ আমার মনে ছিল সে-অর্থটা বাজারে চলতি ছিল না । বর্তমান কালে আমাদের দেশে সংসারটা চার দিকেই সংকুচিত ; মননসাধনের বেলায় মনকে জ্ঞান ও ভাবের উদার ক্ষেত্রে ব্যাপ্ত করে রাখা আর ব্যবহারের বেলায় তাকে সেই সংসারের অতি ছোটাে মাপে কৃশ করে আনা, এ আমি মনে মনেও সহ্য করতে পারতুম না । যে-শ্ৰীকে আইডিয়ালের পথে সঙ্গিনী করতে চাই সেই স্ত্রী ঘরকন্নার গারদে পায়ের বেড়ি হয়ে থাকবে এবং প্রত্যেক চলাফেরায় ঝংকার দিয়ে পিছনে টেনে রাখবে, এমন দুগ্ৰহ আমি স্বীকার করে নিতে নারাজ ছিলুম। আসল কথা, আমাদের দেশের প্রহসনে যাদের আধুনিক বলে বিদ্রুপ করে কলেজ থেকে টাটকা বেরিয়ে আমি সেইরকম নিরবচ্ছিন্ন আধুনিক হয়ে উঠেছিলুম। আমাদের কালে সেই আধুনিকের দল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল । আশ্চর্য এই যে, তারা সত্যই বিশ্বাস করত যে, সমাজকে মেনে চলাই দুৰ্গতি এবং তাকে টেনে চলাই উন্নতি । এ-হেন আমি শ্ৰীযুক্ত সনৎকুমার, একটি ধনশালী কন্যাদায়িকের টাকার থলির হা-করা মুখের সামনে এসে পড়লুম। বাবা বললেন, শুভস্য শীঘ্ৰং । আমি চুপ করে রইলুম ; মনে মনে ভাবলুম, একটু দেখে-শুনে বুঝে-পড়ে নিই। চোখ কান খুলে রাখলুম- কিছু পরিমাণ দেখা এবং অনেকটা পরিমাণ শোনা গেল। মেয়েটি পুতুলের মতো ছোটাে এবং সুন্দর- সে যে স্বভাবের নিয়মে তৈরি হয়েছে তা তাকে দেখে মনে হয় না- কে যেন তার প্রত্যেক চুলটি পাট করে, তার ভুরুটি ঐকে, তাকে হাতে করে গড়ে তুলেছে। সে সংস্কৃতভাষায় গঙ্গার স্তব আবৃত্তি করে পড়তে পারে । তার মা পাথুরে কয়লা পর্যন্ত গঙ্গার জলে ধুয়ে তবে রাধেন ; জীবধাত্রী বসুন্ধরা নানা জাতিকে ধারণ করেন বলে পৃথিবীর সংস্পর্শ সম্বন্ধে তিনি সর্বদাই সংকুচিত ; তার অধিকাংশ ব্যবহার জলেরই সঙ্গে, কারণ জলচর। মৎস্যরা মুসলমান-বংশীয় নয় এবং জলে পেয়াজ উৎপন্ন হয় না । তার জীবনের সর্বপ্রধান কােজ আপনার দেহকে গৃহকে কাপড়াচোপড় ইড়িকুড়ি খাটপালঙ বাসনকোসনকে শোধন এবং মার্জন করা । তার সমস্ত কৃত্য সমাপন করতে বেলা আড়াইটে হয়ে যায় । তার মেয়েটিকে তিনি স্বহন্তে সর্বাংশে এমনি পরিশুদ্ধ করে তুলেছেন যে, তার নিজের মত বা নিজের ইচ্ছা বলে কোনো উৎপাত ছিল না। কোনো ব্যবস্থায় যত অসুবিধাই হােক, সেটা পালন করা তার পক্ষে সহজ হয় যদি তার কোনো