পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○や রবীন্দ্র-রচনাবলী রেখেছে। যেমন রাগিণী বলি তাকেই যা আপনার ভিতরকার সমুদয় সা-রো-গা-মা-গুলোকে সংগীত করে তোলে, তার পর থেকে তাদের আর গোলমাল করবার সাধ্য থাকে না । কিন্তু, সংগীতের ভিতরে এক-একটি সুর অন্য-সকল সুরকে ছাড়িয়ে বিশেষ হয়ে ওঠে- কোনোটাতে মধ্যম, কোনোটাতে কোমলগান্ধার, কোনোটাতে পঞ্চম । আমার ভাইপো বলাই- তার প্রকৃতিতে কেমন করে গাছপালার মূল সুরগুলোই হয়েছে প্ৰবল । ছেলেবেলা থেকেই চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখাই তার অভ্যাস, নড়ে-চড়ে বেড়ানো নয়। পূবদিকের আকাশে কালো মেঘ স্তরে স্তরে স্তম্ভিত হয়ে দাড়ায়, ওর সমস্ত মনটাতে ভিজে হাওয়া যেন শ্রাবণ-অরণ্যের গন্ধ নিয়ে ঘনিয়ে ওঠে ; ঝমােঝম করে বৃষ্টি পড়ে, ওর সমস্ত গা যেন শুনতে পায় সেই বৃষ্টির শব্দ । ছাদের উপর বিকেলবেলাকার রোদন্দুর পড়ে আসে, গা খুলে বেড়ায় ; সমস্ত আকাশ থেকে যেন কী একটা সংগ্রহ করে নেয় । মাঘের শেষে আমের বোল ধরে, তার একটা নিবিড় আনন্দ জেগে ওঠে। ওর রক্তের মধ্যে, একটা কিসের অব্যক্ত স্মৃতিতে ; ফাল্লুনে পুম্পিত শালবনের মতোই ওর অন্তর-প্রকৃতিটা চার দিকে বিস্তৃত হয়ে ওঠে, ভরে ওঠে, তাতে একটা ঘন রঙ লাগে। তখন ওরা একলা বসে বসে আপন মনে কথা কইতে ইচ্ছে করে, যা-কিছু গল্প শুনেছে সব নিয়ে জোড়াতাড়া দিয়ে । অতি পুরানো বটের কোটরে বাসা বেঁধে আছে যে একজোড়া অতি পুরানো পাখি বেঙ্গমা বেঙ্গামী, তাদের গল্প । ঐ ড্যাবা-ড্যাবা-চোখ-মেলে সর্ব-তাকিয়ে-থাকা ছেলেটা বেশি কথা কইতে পারে না। তাই ওকে মনে মনে অনেক বেশি ভাবতে হয় । ওকে একবার পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের বাড়ির সামনে ঘন সবুজ ঘাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে পর্যন্ত নেবে গিয়েছে, সেইটে দেখে আর ওর মন ভারি খুশি হয়ে ওঠে । ঘাসের আস্তরণটা একটা স্থির পদার্থ তা ওর মনে হয় না ; ওর বোধ হয়, যেন ঐ ঘাসের পুঞ্জ একটা গড়িয়ে-চলা খেলা, কেবলই গড়াচ্ছে ; প্রায়ই তারই সেই ঢালু। বেয়ে ও নিজেও গড়াত- সমস্ত দেহ দিয়ে ঘাস হয়ে উঠত- গাড়াতে গড়াতে ঘাসের আগায় ওর ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ি লাগত। আর ও খিলখিল করে হেসে উঠত । রাত্রে বৃষ্টির পরে প্রথম সকালে সামনের পাহাড়ের শিখর দিয়ে কাচা সোনারঙের রোদন্দুর দেবদারুবনের উপরে এসে পড়ে— ও কাউকে না বলে আস্তে আস্তে গিয়ে সেই দেবদারুবনের নিস্তব্ধ ছায়াতলে একলা অবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে, গা ছমছম করে-- এই-সব প্ৰকাণ্ড গাছের ভিতরকার মানুষকে ও যেন দেখতে পায় । তারা কথা কয় না, কিন্তু সমস্তই যেন জানে। তারা-সব যেন অনেক কালের দাদামশায়, “এক যে ছিল রাজাদের আমলের । ওর ভাবে-ভোলা চোখটা কেবল যে উপরের দিকেই তা নয়, অনেক সময় দেখেছি, ও আমার বাগানে বেড়াচ্ছে মাটির দিকে কী খুঁজে খুঁজে। নতুন অঙ্কুরগুলো তাদের কোকড়ানো মাথাটুকু নিয়ে আলোতে ফুটে উঠছে এই দেখতে তার ঔৎসুক্যের সীমা নেই। প্রতিদিন ঝুকে পড়ে পড়ে তাদেরকে যেন জিজ্ঞাসা করে, “তার পরে ? তার পরে ? তার পরে ?” তারা ওর চির-অসমাপ্ত গল্প । সদ্য গজিয়ে-ওঠা কচি কচি পাতা, তাদের সঙ্গে ওর কী যে একটা বয়স্যভাব তা ও কেমন করে প্রকাশ করবে। তারাও ওকে কী একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবার জন্য আঁকুপাকু করে। হয়তো বলে, “তোমার * ।” হয়তো বলে, “তোমার মা কোথায় গেল।’ বলাই মনে মনে উত্তর করে, “আমার মা তো কেউ গাছের ফুল তোলে এইটো ওর বড়ো বাজে । আর-কারও কাছে ওর এই সংকোচের কোনো মানে নেই, এটাও সে বুঝেছে । এইজন্যে ব্যথাটা লুকোতে চেষ্টা করে । ওর বয়সের ছেলেগুলো গাছে টিল মেরে মেরে আমলকী পাড়ে, ও কিছু বলতে পারে না, সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় । ওর সঙ্গীরা ওকে খ্যাপাবার জন্যে বাগানের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে ছড়ি দিয়ে দুপাশের গাছগুলোকে মারতে মারতে চলে, ফস করে বকুলগাছের একটা ডাল ভেঙে নেয়- ওর কঁদতে লজা করে পাছে সেটাকে কেউ পাগলামি মনে করে । ওর সব চেয়ে বিপদের দিন, যেদিন ঘাসিয়াড়া ঘাস কাটতে আসে। কেননা, ঘাসের ভিতরে ভিতরে ও প্রত্যহ দেখে দেখে বেড়িয়েছে ; এতটুকু টুকু লতা, বেগনি