পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

so *Կլ রবীন্দ্র-রচনাবলী হয় এইজন্য তাঁহাকে নিবিড় করিয়া বাধিয়া রাখাই হিন্দুসন্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য- তাহারা মানুষের চিত্তকে প্রাচীর ঘেরিয়া বন্দিীশালায় পরিণত করিবার প্রস্তাব না করিয়া বিশ্ববিদ্যার হাওয়া বহিষ্কার জন্য তাহার চাৰি দিকে বড়ো বড়ো দরজা ফুটাইবার উদযোগ যে করিতেছেন ইহা ভ্রমক্রমে অবিবেচনাবশতই করিতেছেন। তাহা সত্য নহে। আসল কথা, মানুষ মুখে যাহা বলে তাঁহাই যে তাহার সত্য বিশ্বাস তাহা সকল সময়ে ঠিক নহে। তাহার অন্তরতম সহজবোধের মধ্যে অনেক সময় এই বাহবিশ্বাসের একটা প্রতিবাদ বাস করে। বিশেষত যে সময়ে দেশে প্রাচীন সংস্কারের সঙ্গে নূতন উপলব্ধির দ্বন্দ্ব চলিতেছে সেই ঋতুপরিবর্তনের সন্ধিকালে আমরা মুখে যাহা বলি সেটাকেই আমাদের অন্তরের প্রকৃত পরিচয় বলিয়া গ্ৰহণ করা চলে না। ফায়ুন মাসে মাঝে মাঝে বসন্তের চেহারা বদল হইয়া গিয়া হঠাৎ উত্তরে হাওয়া বহিতে থাকে, তখন পীেয় মাস ফিরিয়া আসিল বলিয়া ভ্রম হয়, তবু এ কথা জোর করিয়াই বলা যাইতে পারে উত্তরে হাওয়া ফায়ুনের অন্তরের হাওয়া নহে। আমের যে বোল ধরিয়াছে, নব কিশলয়ে যে চিকুণ তরুণতা দেখিতেছি, তাহাতেই ভিতরকার সত্য সংবাদটা প্রকাশ হইয়া পড়ে। আমাদেরও দেশের মধ্যে প্রাণের হাওয়াই বহিয়াছে— এই হাওয়া বহিয়াছে বলিয়াই আমাদের জড়তা ভাঙিয়ছে এবং গলা ছাড়িয়া বলিতেছি। যাহা আছে তাহাকে রাখিয়া দিব। এ কথা ভুলিতেছিযাহা যেখানে যেমন আছে তাহাকে সেখানে তেমনি করিয়া ফেলিয়া রাখিতে যদি চাই। তবে কোনাে চেষ্টা না করাই তাহার পন্থা। খেতের মধ্যে আগাছাকে প্রবল করিয়া তুলিবার জন্য কেহ চাষ করিয়া মই চালাইবার কথা বলে না। চেষ্টা করিতে গেলেই সেই নাড়াচাড়াতেই ক্ষয়ের কার্য পরিবর্তনের কার্য দ্রুতবেগে অগ্রসর হইবেই। নিজের মধ্যে যে সঞ্জীবনীশক্তি অনুভব করিতেছি, মনে করিতেছি। সেই সঞ্জীবনীশক্তি প্রয়োগ করিয়াই মৃতকে রক্ষা করিব। কিন্তু জীবনীশক্তির ধর্মই এই, তাহা মৃতকে প্রবলবেগে মারিতে থাকে এবং যেখানে জীবনের কোনাে আভাস আছে সেইখনেই আপনাকে প্রয়োগ করে। কোনো জিনিসকে স্থির করিয়া রাখা তাহার কাজ নহে- যে জিনিস বাড়িতে পারে তাহাকে সে বাড়াইয়া তুলিবে, আর যাহার বাড় ফুরাইয়াছে তাহাকে সে ধ্বংস করিয়া অপসারিত করিয়া দিবে। কিছুকেই সে স্থির রাখিবে না। তাই বলিতেছিলাম আমাদের মধ্যে জীবনীশক্তির আবির্ভাব হইয়া আমাদিগকে নানা চেষ্টায় প্রবৃত্ত করিতেছে- এই কথাই এখনকার দিনের সকলের চেয়ে বড়ো সত্য- তাহা মৃত্যুকে চিরস্থায়ী করিবার পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হইয়াছে ইহাই বড়ো কথা নহে- ইহা তাহার একটা ক্ষণিক লীলা মাত্র। শ্ৰীযুক্ত গোখোেলর প্রাথমিক শিক্ষার অবশ্য প্রবর্তনের বিল সম্বন্ধে কোনো কোনো শিক্ষিত লোক এমন কথা বলিতেছেন যে, আধুনিক শিক্ষায় আমাদের তো মাথা ঘুরাইয়া দিয়াছে আবার দেশের জনসাধারণেরও কি বিপদ ঘটাইব ? যাহারা এই কথা বলিতেছেন তাহারা নিজের ছেলেকে আধুনিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিতে ক্ষান্ত হইতেছেন না। এরূপ অদ্ভুত আত্মবিরোধ কেন দেখিতেছি ? ইহা যে কপটাচার তাহা নহে! ইহা আর কিছু নয়, অন্তরে নব বিশ্বাসের বসন্ত আসিয়াছে, মুখে পুরাতন সংস্কারের হাওয়া মরে নাই। সেইজন্য আমরা যাহা করিবার তাহা করিতে বসিয়াছি অথচ বলিতেছি আর-এক কালের কথা। আধুনিক শিক্ষায় যে চঞ্চলত আনিয়াছে সেই চঞ্চলতা সত্ত্বেও তাহার মঙ্গলকে আমরা মনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়াছি। তাঁহাতে যে বিপদ আছে সেই বিপদকেও আমরা স্বীকার করিয়া লইয়াছি। নিরাপদ মৃত্যুকে আর আমরা বরণ করিতে রাজি নই, সেইজন্য জীবনের সমস্ত দায় সমস্ত পীড়কেও মাথায় করিয়া লইবার জন্য আজ আমরা বীরের মতো প্ৰস্তুত হইতেছি। জানি উলটাপালট হইবে, জানি বিস্তুর ভুল করিব, জানি কোনো পুরাতন ব্যবস্থাকে নাড়া দিতে গেলেই প্রথমে দীর্ঘকাল বিশৃঙ্খলতার নানা দুঃখ ভোগ করিতে হইবে-চিরসঞ্চিত ধুলার হাত হইতে ঘরকে মুক্ত করিবার জন্য বঁট দিতে গেলে প্রথমটা সেই ধূলাই খুব প্রচুর পরিমাণে ভোগ করিতে হইবেএই সমস্ত অসুবিধা ও দুঃখ-বিপদের আশঙ্কা নিশ্চয় জানি তথাপি আমাদের অন্তরের ভিতরকার নূতন প্ৰাণের আবেগ আমাদিগকে তো স্থির থাকিতে দিতেছে না। আমরা বঁচিব, আমরা অচল হইয়া পড়িয়া থাকিব না, এই ভিতরের কথাটাই আমাদের মুখের সমন্ত কথাকে বারংবার সবেগে ছাপাইয়া উঠিতেছে। জাগরণের প্রথম মুহুর্তে আমরা আপনাকে অনুভব করি, পরীক্ষণেইচারিদিকের সমস্তকে অনুভব করিতে থাকি। আমাদের জাতীয় উদবোধনের প্রথম আরম্ভেই আমরা যদি নিজেদের পার্থক্যকেই প্রবলভাবে উপলব্ধি করিতে পারি। তবে ভয়ের কারণ নাই- সেই জাগরণই চারিদিকের বৃহৎ উপলব্ধিকেও উন্মেষিত