পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা సి) কথায় প্রকাশ হইয়া অবসান হইল। সঙ্গীত সেই “হায়” শব্দটি লইয়া তাহাকে বিস্তার করিতে থাকে, “হায়” শব্দের হৃদয় উদঘাটন করিতে থাকে, “হায়” শব্দের হৃদয়ের মধ্যে যে গভীর দুঃখ, যে অতৃপ্ত বাসনা, যে আশার জলাঞ্জলি প্রচ্ছন্ন আছে, সঙ্গীত তাহাই টানিয়া টানিয়া বাহির করিতে থাকে, “হায়” শব্দের প্রাণের মধ্যে যতটা কথা ছিল সবটা তাহাকে দিয়া বলাইয়া লয়। কিন্তু কবিতার কাজ আরো বিস্তৃত। চিত্রকরের ন্তায় মুহূর্তের বাহীও তাহার বর্ণনীয়, গায়কের ন্যায় ক্ষণকালের ভাবোচ্ছাসও র্তাহার গেয় । তাহা ছাড়া—জীবনের গতি-স্রোত র্তাহার বর্ণনীয় বিষয়। ভাব হইতে ভাবান্তরে তাহাকে গমন করিতে হয় । ভাবের গঙ্গোত্রী হইতে ভাবের সাগর-সঙ্গম পৰ্য্যস্ত র্তাহাকে অকুসরণ করিতে হয় । কেবলমাত্র স্থির আকৃতি তিনি চিত্র করেন না, এক সময়ের স্থায়ী ভাব মাত্র তিনি বর্ণনা করেন না, গম্যমান শরীর, প্রবহমান ভাব, পরিবর্তমান অবস্থা তাহার কবিতার বিষয় —অতএব ম্যাথিউ আর্ণলডের মতে চলনশীল ভাবের প্রত্যেক ছায়ালোক সঙ্গীতে প্রতিবিঙ্গিত হইতে পারে না । সঙ্গীত একটি স্থায়ী স্থির ভাবের ব্যাখ্যা করে মাত্র । কিন্তু আমরা এই বলি যে, গতিশীল ভাব যে সঙ্গীতের পক্ষে একেবারে অনুসরণীয় তাহা নহে, তবে এখনো সঙ্গীতের সে বয়স হয় নাই। সঙ্গীত ও কবিতায় আমরা আর কিছু প্রভেদ দেখি না, কেবল উন্নতির তারতম্য । উভয়ে যমজ ভ্রাতা, এক মায়ের সস্তান, কেবল উভয়ের শিক্ষার বৈলক্ষণ্য হইয়াছে মাত্র । দেখা গেল সঙ্গীত ও কবিতা এক শ্রেণীর । কিন্তু উভয়ের সহিত আমরা কতখানি ভিন্ন আচরণ করি, তাহা মনোযোগ দিয়া দেখিলেই প্রতীতি হইবে। এখন সঙ্গীত যেরূপ হইয়াছে, কবিতা যদি সেইরূপ হইত, তাহা হইলে কি হইত ? মনে কর এমন যদি নিয়ম হইত যে, যে কবিতায় চতুর্দশ ছত্রের মধ্যে, বসন্ত, মলয়ানিল, কোকিল, সুধাকর, রজনীগন্ধ, টগর ও দুরন্ত এই কয়েকটি শব্দ বিশেষ শৃঙ্খলা অনুসারে পাঁচ বার করিয়া বসিবে, তাহারই নাম হইবে কবিতা বসন্ত —ও যদি কবিতাপ্রিয় ব্যক্তিগণ কবিদিগকে ফরমাস করিতেন, “ওহে চণ্ডিদাস, একটা কবিতা বসন্ত, ছন্দ ত্রিপদী আওড়াও ত !” অমনি যদি চণ্ডিদাস আওড়াইতেন— বসন্ত মলয়ানিল, রজনীগন্ধা কোকিল, দুরন্ত টগর সুধাকর— মলয়ানিল বসন্ত, রজনীগন্ধ দুরন্ত, সুধাকর কোকিল টগর । ও চারিদিক হইতে "আহ!” “আহা” পড়িয়া যাইত, কারণ কথাগুলি ঠিক নিয়মানুসারে