পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/১৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ফুটা হইলেই তাহার দ্বারা আর কোন কাজ পাওয়া যায় না। তখন স্বাহা তােমাকে ভাসাইয়া রাখে তাহা তােমাকে ডুবায় । ধৰ্ম্মের বল নাকি অনন্তের নিঝর হইতে নিত, এই জয়ই সে আপাতত অসুবিধা, সহস্রবার পরাভব, এমন কি মৃত্যুকে পর্যন্ত ডরায় না। ফলাফল লাভেই বুদ্ধি বিচারের সীমা, মৃত্যুতেই বুদ্ধি বিচারের সীমা—কিন্তু ধর্মের সীমা কোথাও নাই। অতএব এই অতি সামান্য বুদ্ধি বিবেচনা বিতর্ক হইতে কি একটি সমগ্র জাতি চিরদিনের জন্য পুরুষানুক্রমে বল পাইতে পারে। একটি মাত্র কুপে সমস্ত দেশের তৃষা নিবারণ হয় না। তাহাও আবার গ্রীষ্মের উত্তাপে শুকাইয়া যায়। কিন্তু যেখানে চির-নিঃসৃত নদী প্রবাহিত সেখানে যে কেবলমাত্র তৃষা-নিবারণের কারণ বর্তমান তাহা নহে, সেখানে সেই নদী হইতে স্বাস্থ্যজনক বায়ু বহে, দেশের মলিনতা অবিশ্রাম ধৌত হইয়া যায়, ক্ষেত্র শস্যে পরিপূর্ণ হয়, দেশের মুখশ্রীতে সৌন্দৰ্য প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে। তেমনি বুদ্ধি-বলে কিছু দিনের জন্য সমাজ রক্ষা হইতে পারে, কিন্তু ধর্ম-বলে চিরদিন সমাজের রক্ষা হয়, আবার তাহার আনুষঙ্গিকস্বরূপে চতুর্দিক হইতে সমাজের স্ফুর্তি, সমাজের সৌন্দৰ্য্য ও স্বাস্থ্য বিকাশ দেখা যায়। বদ্ধ-গুহায় বাস করিয়া আমি বুদ্ধিবলে রসায়নতত্ত্বের সাহায্যে কোন মতে অক্সিজেন গ্যাস নির্মাণ করিয়া কিছু কাল প্রাণধারণ করিয়া থাকিতেও পারি কিন্তু মুক্ত বায়ুতে যে চিরপ্রবাহিত প্রাণ, চিরপ্রবাহিত ঘূর্তি, চিরপ্রবাহিত স্বাস্থ্য ও আনন্দ আছে তাহা ত বুদ্ধিবলে গড়িয়া তুলিতে পারি না। সঙ্কীর্ণতা বৃহত্ত্বের মধ্যে যে কেবল মাত্র কম ও বেশী লইয়া প্রভেদ তাহা নহে, তাহার আনুষঙ্গিক ফলাফলের প্রভেদই গুরুতর। ধর্মের মধ্যে সেই অত্যন্ত বৃহত্ব আছে—যাহাতে সমস্ত জাতি একত্রে বাস করিয়াও তাহার বায়ু দূষিত করিতে পারে না। ধৰ্ম্ম অনন্ত আকাশের ন্যায় ; কোটি কোটি মনুষ্য পশু পক্ষী হইতে কীট পতঙ্গ পৰ্যন্ত অবিশ্রাম নিশ্বাস ফেলিয়া তাহাকে কলুষিত করিতে পারে না। আর যাহাই আশ্রয় কর না কেন, কালক্রমে তাহা দূষিত ও বিষাক্ত হইবেই। কোনটা বা অল্প দিনে হয়, কোনটা বা বেশী দিনে হয়। এই জন্যই বলিতেছি—মনুষ্যত্বের যে বৃহত্তর আদর্শ আছে, তাহাকে যদি উপস্থিত আবশ্যকের অনুরােধে কোথাও কিছু সঙ্কীর্ণ করিয়া লও, তবে নিশ্চয়ই ত্বরায় হউক আর বিলম্বেই হউক, তাহার বিশুদ্ধতা সম্পূর্ণ নষ্ট হইয়া যাইবে। সে আর তােমাকে বল ও স্বাস্থ্য দিতে পারিবে না শুব্ধ সত্যকে যদি বিকৃত সত্য, সঙ্কীর্ণ সত্য, আপাতত সুবিধার সত্য করিয়া তােল তবে উত্তরােতর নষ্ট হইয়া সে মিথ্যায় পরিণত হইবে, কোথাও তাহার পরিত্রাণ নাই। কারণ, অসীমের উপর সত্য দাড়াইয়া আছে, । 1