পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

b- রবীন্দ্র-রচনাবলী ডুবিবার স্থান। যখন একটা কুকুর একটি গোলাপ ফুল দেখে, তখন তাহার দেখা অতি শীঘ্রই ফুরাইয়া যায়—কারণ ফুলটি কিছু বড় নহে। কিন্তু এক জন ভাবুক যখন সেই ফুলটি দেখেন তখন তাহার দেখা শীঘ্ৰ ফুরায় না, যদিও সে ফুলটি দেড় ইঞ্চি অপেক্ষা আয়ত নহে । কারণ সে গোলাপ ফুলের গভীরতা নিতান্ত সামান্য নহে। যদিও তাহাতে দুই ফোটার বেশী শিশির ধরে না, তথাপি হৃদয়ের প্রেম তাহাকে যতই দাও না কেন, তাহার ধারণ করিবার স্থান আছে। সে ক্ষুদ্রকায় বলিয়া যে তোমার হৃদয়কে তাহার বক্ষস্থিত কীটের মত গোটাকতক পাপড়ির মধ্যে কারারুদ্ধ করিয়া রাখে তাহা নহে। সে আরো তোমাকে এমন এক নূতন বিচরণের স্থানে লইয়া যায়, যেখানে এত বেশী স্বাধীনতা যে এক প্রকার অনির্দেশু অনিৰ্ব্বচনীয়তার মধ্যে হারা হইয়। যাইতে হয়। তখন এক প্রকার অস্ফুট দৈববাণীর মত হৃদয়ের মধ্যে শুনিতে পাওয়া যায়, যে, সকলেরই মধ্যে অসীম আছে ; যাহাকেই তুমি ভাল বাসিবে সেই তোমাকে তাহার অসীমের মধ্যে লইয়া যাইবে, সেই তোমাকে তাহার অসীম দান করিবে। কে না জানেন, যাহাকে যত ভাল বাসা যায় সে ততই বেশী হইয়া উঠে—নহিলে প্রেমিক কেন বলিবেন, “জনম অবধি হম রূপ নেহারস্থ নয়ন না তিরপিত ভেল !” একটা মানুষ যত বড়ই হউক না কেন, তাহাকে দেখিতে কিছু বেশীক্ষণ লাগে না—কিন্তু আজন্ম কাল দেখিয়াও যখন দেখা ফুরায় না তখন সে নাজানি কত বড় হইয়া উঠিয়াছে ! ইহার অর্থ আর কিছুই নহে, অমুরাগের প্রভাবে প্রেমিক একজন মানুষের অন্তরস্থিত অসীমের মধ্যে প্রবেশাধিকার পাইয়াছেন, সেখানে, সে মানুষের আর অন্ত পাওয়া যায় না ; হৃদয় যতই দাও ততই সে গ্রহণ করে, যত দেখ ততই নতুন দেখা যায়, যত তোমার ক্ষমতা আছে ততই তুমি নিমগ্ন হইতে পার । এই জন্যই যথার্থ অঙ্কুরাগের মধ্যে এক প্রকার ব্যাকুলতা আছে। সে এতখানি পায় যে তাহা প্রাণ ভরিয়া আয়ত্ত করিতে পারে না—তাহার এত বেশী তৃপ্তি বর্তমান, যে, সে-তৃপ্তিকে সে সৰ্ব্বতোভাবে অধিকার করিতে পারে না ও তাহ স্বমধুর অতৃপ্তিরূপে চতুর্দিক পূর্ণ করিয়া বিরাজ করিতে থাকে। যেখানে অনুরাগ নাই সেইখানেই সীমা, সেইখানেই মহা অসীমের দ্বার রুদ্ধ, সেইখানেই চারিদিকে লৌহের ভিত্তি, কারাগার । জগৎকে যে ভালবাসিতে শিখে নাই, সে ব্যক্তি অন্ধকূপের মধ্যে আটকা পড়িয়াছে। সে মনে করিতেও পারে না এই টুকুর বাহিরেও কিছু থাকিতে পারে। তাহার নিজের পায়ের শিকলিটার ঝম্ ঝম্ শব্দই তাহার জগতের একমাত্র