পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অচলিত) দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আলোচনা > X. আশ্চৰ্য্য বোধ হয়। বাঙ্গালা দেশ দেখিতে ভাল নয় ! এমন মায়ের মত দেশ আছে ! এত কোল-ভরা শস্ত, এমন স্যামল পরিপূর্ণ সৌন্দৰ্য্য, এমন স্নেহধারাশালিনী ভাগীরথীপ্রাণ কোমলহৃদয়া, তরুলতাদের প্রতি এমনতর অনিৰ্ব্বচনীয় করুণাময়ী মাতৃভূমি কোথায় ! একজন বিদেশী আসিয়া যাহা বলে শোভা পায়, কিন্তু আজন্মকাল ইহার কোলে যে মানুষ হইয়াছে সেও ইহার সৌন্দৰ্য্য দেখিতে পায় না ! সে ব্যক্তি যে প্রেমিক নহে ইহা নিশ্চয়ই । সুতরাং বাংলা দেশে সে বাস করে মাত্র, কিন্তু বাংলা দেশ সে দেখেই নি—বাংলা দেশে সে কখনো যায় নি, ম্যাপে দেখিয়াছে মাত্র। এত দেশে গিয়াছি এত নদী দেখিয়াছি কিন্তু বাংলার গঙ্গা যেমন এমন নদী আর কোথাও দেখি নাই। কিন্তু কেন ? অমুক দেশে একটা নদী আছে সেটা গঙ্গার চেয়ে চওড়া— অমুক সাগরে একটা নদী পড়িয়াছে সেটা গঙ্গার চেয়ে দীর্ঘ—অমুক স্থানে একটা নদী বহিতেছে, গঙ্গার চেয়ে তাহার তরঙ্গ বেশী। ইত্যাদি । কেন । এই কেন লইয়াই যত মারামারি । যে ভালবাসে সে কেনর উত্তর দিতে পারে না। তুমি তর্ক করিলে বাংলার চেয়ে কাশ্মীর ভাল দেশ হইয়া দাড়ায় কিন্তু তবু আমার কাছে কেন বাংলাই ভাল দেশ । তার্কিক বলেন, বাল্যাবধি বাংলা দেশটা তোমার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, তাই ভাল লাগিতেছে । ঠিক কথা । কিন্তু অভ্যাস হইয়া যাওয়ার দরুন ভাল লাগিবার কি কারণ হইতে পারে । তাহাদের কথার ভাবটা এই যে বাংলা দেশে আসলে যাহা নাই, আমি তাহাই যেন নিজের তহবিল হইতে দেশকে অপণ করি । এ কথা কোন কাজের নহে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রেম একটি সাধনা । ভাল বাসিয়া আজন্ম প্রত্যহ দেশের পানে চাহিয়া দেখিলে দেশ সদয় হইয়া তাহার প্রাণের মধ্যে আমাদিগকে লইয়া যান—কারণ সকলেরই প্রাণ আছে। ভাল বাসিলে সকলেই তাহার প্রাণে ডাকিয় লয় । বাহ আকার-আয়তনের মধ্যে স্বাধীনতা নাই, তাহা বাধাবিপত্তিময়—আকার আয়তনের অতীত প্রাণের মধ্যেই স্বাধীনতা—সেখানে পায়ে কিছু ঠেকে না, চোখে কিছু পড়ে না, শরীরে কিছুই বাধে না—কেবল এক প্রকার অনিৰ্ব্বচনীয় স্বাধীনতার আনন্দ । ইহার কাছে কি আর "কেন” ঘেষিতে পারে! স্বদেশে আমাদের হৃদয়ের কি স্বাধীনতা ! স্বদেশে আমাদের কতখানি জায়গা ! কারণ স্বদেশের শরীর ক্ষুদ্র, স্বদেশের হৃদয় বৃহৎ । স্বদেশের হৃদয়ে স্থান পাইয়াছি। স্বদেশের প্রত্যেক গাছপালা আমাদের চোখে ঠেকে না, আমরা