পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৪৬ ৷ রবীন্দ্র-রচনাবলী দুজনেরই কপাল ভাঙল তখন আমার দিদিশাশুড়ী পণ করে বসলেন যে তার একমাত্র অবশিষ্ট নাতির জন্তে তিনি আর রূপসীর খোজ করবেন না। আমি কেবলমাত্র সুলক্ষণের জোরে এই ঘরে প্রবেশ করতে পারলুম—নইলে আমার আর কোনো অধিকার ছিল না । আমাদের ঘরে এই ভোগের সংসারে খুব অল্প স্ত্রীই যথার্থ স্ত্রীর সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু সেটাই নাকি এখানকার নিয়ম, তাই মদের ফেনা আর নটীর নূপুরনিক্কণের তলায় তাদের জীবনের সমস্ত কাল্লা তলিয়ে গেলেও তারা কেবলমাত্র বড়ো ঘরের ঘরনীর অভিমান বুকে অঁাকড়ে ধরে মাথাটাকে উপরে ভাসিয়ে রেখেছিলেন । অথচ আমার স্বামী মদও ছুলেন না, আর নারীমাংসের লোভে পাপের পণ্যশালার দ্বারে দ্বারে মহন্তত্বের থলি উজাড় করে ফিরলেন না, এ কি আমার গুণে ? পুকুরের উদ্ভ,াস্ত উন্মত্ত মনকে বশ করবার মতো কোন মন্ত্র বিধাতা আমাকে দিয়েছিলেন ? কেবলমাত্রই কপাল—আর কিছুই না। আর তাদের বেলাতেই কি পোড়া বিধাতার হুশ ছিল না—সকল অক্ষরই বাক হয়ে উঠল । সন্ধ্যা হতে না হতেই তাদের ভোগের উৎসব মিটে গেল—কেবল রূপযেীবনের বাতিগুলো শূন্য সভায় সমস্ত রাত ধরে মিছে জলতে লাগল। কোথাও সংগীত নেই, কেবলমাত্রই জলা । আমার স্বামীর পৌরুষকে তার দুই ভাজ অবজ্ঞা করবার ভান করতেন । এমন মানী-সংসারের তরীটাকে একটিমাত্র স্ত্রীর আঁচলের পাল তুলে দিয়ে চালানো ? কথায় কথায় তাদের কত খোটাই খেয়েছি । আমি যেন আমার স্বামীর সোহাগ কেবল চুরি করে করে নিচ্ছি। কেবল ছলনা, তার সমস্তই কৃত্রিম ; এখনকার কালের বিবিয়ানার নির্লজ্জত। আমার স্বামী আমাকে হালফেশানের সাজে-সজ্জায় সাজিয়েছেন—সেই সমস্ত রঙবেরঙের জ্যাকেট-শাড়ি-শেমিজ-পেটিকোটের আয়োজন দেখে তারা জলতে থাকতেন। রূপ নেই, রূপের ঠাট ! দেহটাকে যে একেবারে দোকান করে সাজিয়ে তুললে গো–লজ্জা করে না ! আমার স্বামী সমস্তই জানতেন। কিন্তু মেয়েদের উপর যে র্তার হৃদয় করুণায় ভরা। তিনি আমাকে বারবার বলতেন, রাগ ক’রো না । মনে আছে আমি একবার তাকে বলেছিলুম, মেয়েদের মন বড়োই ছোটো, বড়ো বাকা । তিনি জবাব দিয়েছিলেন, চীনদেশের মেয়েদের পা যেমন ছোটো, যেমন বাকা । সমস্ত সমাজ যে চারিদিক থেকে আমাদের মেয়েদের মনকে চেপে ছোটো করে বাকিয়ে রেখে দিয়েছে। ভাগ্য যে ওদের জীবনটাকে নিয়ে জুয়ো খেলছে—দান-পড়ার উপরই সমস্ত নির্ভর, নিজের কোন অধিকার ওদের আছে ?