পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

{Q ঘরে-বাইরে 8 আমার জা-রা তাদের দেওরের কাছে যা দাবি করতেন তাই পেতেন। তাদের দাবি স্থায্য কি অন্যায্য তিনি তার বিচারমাত্র করতেন না। আমার মনের ভিতরটা জলতে থাকত যখন দেখতুম তারা এর জন্তে একটুও কৃতজ্ঞ ছিলেন না। এমন কি, আমার বড়ো জা, যিনি জপে তপে ব্রতে উপবাসে ভয়ংকর সাত্ত্বিক, বৈরাগ্য ধার মুখে এত বেশি খরচ হত যে মনের জন্তে সিকি পয়সার বাকি থাকত না,—তিনি বারবার আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন যে তাকে তার উকিল দাদা বলেছেন যদি আদালতে তিনি নালিশ করেন তা হলে তিনি—সে কত কী, সে আর ছাই কী লিখব। আমার স্বামীকে কণা দিয়েছি যে, কোনোদিন কোনো কারণেই আমি এদের কথার জবাব করব না, তাই জালা আরও আমার অসহ হত ; আমার মনে হত, ভালো হবার একটা সীমা আছে—সেটা পেরিয়ে গেলে কেমন যেন তাতে পৌরুষের ব্যাঘাত হয়। আমার স্বামী বলতেন, আইন কিংবা সমাজ তার ভাজেদের স্বপক্ষ নয়, কিন্তু একদিন স্বামীর অধিকারে যেটাকে নিজের বলেই তারা নিশ্চিত জেনেছিলেন আজ সেটাকেই ভিক্ষুকের মতো পরের মন জুগিয়ে চেয়ে-চিন্তে নিতে হচ্ছে এ-অপমান যে বড়ো কঠিন। এর উপরেও আবার কৃতজ্ঞতা দাবি করা ? মার খেয়ে আবার বখশিশ দিতে হবে ?— সত্য কথা বলব ? অনেকবার আমি মনে ভেবেছি, আর একটু মন্দ হবার মতো তেজ আমার স্বামীর থাকা উচিত ছিল। আমার মেজো জা অন্ত ধরণের ছিলেন । তার বয়স অল্প—তিনি সাত্ত্বিকতার ভড়ং করতেন না। বরঞ্চ তার কথাবার্তা-হাসিঠাট্টায় কিছু রসের বিকার ছিল । যে-সব যুবতী দাসী তার কাছে রেখেছিলেন তাদের রকমসকম একেবারেই ভালো নয়। তা নিয়ে কেউ আপত্তি করবার লোক ছিল না—কেননা এ-বাড়ির ওই রকমই দস্তুর । আমি বুঝতুম আমার স্বামী যে অকলঙ্ক আমার এই বিশেষ সৌভাগ্য তার কাছে অসহ। তাই তার দেওরের যাতায়াতের পথেঘাটে নানারকম ফাদ পেতে রাখতেন। এ কথাটা কবুল করতে আমার সব চেয়ে লজ্জা হয় যে, আমার আমন স্বামীর জন্তেও মাঝে মাঝে আমার মনে ভয়-ভাবনা চুকত। এখানকার হাওয়াটাই ষে ঘোলা— তার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ জিনিসকেও স্বচ্ছ বোধ হয় না। আমার মেজো জা মাঝে মাঝে এক-এক দিন নিজে রেথে-বেড়ে দেওরকে আদর করে খেতে ডাকতেন । আমার ভারি ইচ্ছে হত, তিনি যেন কোনো ছুতে ক’রে বলেন, না, আমি যেতে পারব না –যা মন তার তো একটা শাস্তি পাওনা আছে। কিন্তু ফি বারেই যখন তিনি হাসিমুখে নিমন্ত্রণ রাখতে যেতেন আমার মনের মধ্যে একটু কেমন—সে আমার অপরাধ—কিন্তু কী করব, আমার মন মানত না—মনে হত এর মধ্যে পুরুষমানুষের