পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ›ዓ¢ যেটা চাচ্ছে বাইরের দিক থেকে সেটা পেতেই হবে, প্রকৃতিতে ভিতরে বাইরে এই রফাটাই সত্য। এই সত্যকে যে-শিক্ষা মানতে দেয় না তাকেই আমরা বলি নীতি, এইজন্তেই নীতিকে আজ পর্যন্ত কিছুতেই মাহূব মেনে উঠতে পারছে না । যারা কাড়তে জানে না, ধরতে পারে না, একটুতেই যাদের মুঠে আলগা হয়ে যায়, পৃথিবীতে সেই আধমরা এক দল লোক আছে, নীতি সেই বেচারাদের সান্থন দিক । কিন্তু যার সমস্ত মন দিয়ে চাইতে পারে, সমস্ত প্রাণ দিয়ে ভোগ করতে জানে, যাদের দ্বিধা নেই সংকোচ নেই, তারাই প্রকৃতির বরপুত্র। তাদের জন্তেই প্রকৃতি যা-কিছু স্বন্দর, যা-কিছু দামি সাজিয়ে রেখেছে। তারাই নদী সাতরে আসবে, পাচিল ডিঙিয়ে পড়বে, দরজা লাধিয়ে ভাঙবে, পাবার যোগ্য জিনিস ছিনিয়ে কেড়ে নিয়ে চলে যাবে । এতেই যথার্থ আনন্দ এতেই দামি জিনিসের দাম । প্রকৃতি আত্মসমপণ করবে,—কিন্তু সে দস্থ্যর কাছে । কেননা, চাওয়ার জোর, নেওয়ার জোর, পাওয়ার জোর সে ভোগ করতে ভালোবাসে—তাই আধমরা তপস্বীর হাড়বের-করা গলায় সে আপনার বসস্তফুলের স্বয়ংবরের মালা পরাতে চায় না। নহবতখানায় রোশনচৌকি বাজছে—লগ্ন বয়ে যায় যে, মন উদাস হয়ে গেল। বর কে ? আমিই বর—যে মশাল জালিয়ে এসে পড়তে পারে, বরের আসন তারই । প্রকৃতির বর আসে অনাহুত । লজ্জা ? না, আমি লজ্জা করি নে। যা দরকার আমি তা চেয়ে নিই, না চেয়েও নিই । লজ্জা করে যারা নেবার যোগ্য জিনিস নিলে না, তারা সেই না-নেবার দুঃখটাকে চাপা দেবার জন্যেই লজ্জাটাকে বড়ো নাম দেয়। এই যে পৃথিবীতে আমরা এসেছি এ হচ্ছে রিয়ালিটির পৃথিবী—কতকগুলো বড়ো কথায় নিজেকে ফাকি দিয়ে খালি-পেটে খালি-হাতে যে-মানুষ এই বস্তুর হাট থেকে চলে গেল, সে কেন এই শক্ত মাটির পৃথিবীতে জন্মেছিল ? আসমানে আকাশকুন্থমের কুঞ্জবনে কতকগুলো মিষ্ট বুলির বাধা-তানে বাশি বাজাবার জন্তে ধর্মবিলাসী বাবুর দলের কাছ থেকে তারা বায়না নিয়েছিল না কি ? আমার সে-বাশির বুলিতেও দরকার নেই, আমার সেআকাশকুন্থমেও পেট ভরবে না। আমি যা চাই তা আমি খুবই চাই । তা আমি দুই হাতে করে চটকাব, দুই পায়ে করে দলব, সমস্ত গায়ে তা মাখব, সমস্ত পেট ভরে তা খাব । চাইতে আমার লজ্জা নেই, পেতে আমার সংকোচ নেই। যারা নীতির উপবাসে শুকিয়ে শুকিয়ে অনেক কালের পরিত্যক্ত খাটিয়ার ছারপোকার মতো একেবারে পাতলা সাদা হয়ে গেছে তাদের টী টী গলার ভৎসনা আমার কানে পৌছবে না।