পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২১ e রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বর্ষে তারায় জলে উঠেছে। ভয়ংকর তার প্রণয়ের পক্ষপাত—মানুষকে সে কামনা করেছে বলেই যুগযুগান্তরের লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে তার সেই কামনার কাছে বলি দিতে দিতে এসেছে । স্বজন-প্রলয়ের সেই ভয়ংকরী “আমি চাই” বাণী আজ মেয়েদের মধ্যেই মূর্তিমতী। সেই জন্তেই ভীরু পুরুষ স্বজনের সেই আদিম বন্যাকে বাধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে পাছে সে তাদের কুমড়োখেতের মাচাগুলোকে অট্টকলহাস্তে ভাসিয়ে দিয়ে নাচতে নাচতে চলে যায়। পুরুষ মনে করে আছে এই বাধকে সে চিরকালের মতো পাক করে বেঁধে রেখেছে । জমছে, জল জমছে,— হ্রদের জলরাশি আজ শাস্ত গম্ভীর, আজ সে চলেও না, আজ সে বলেও না, পুরুষের রান্নাঘরের জলের জাল নিঃশব্দে ভরতি করে । কিন্তু চাপ আর সইবে না, বাধ ভাঙবে,—তখন এতদিনের বোবা শক্তি “আমি চাই” “আমি চাই” বলে গর্জন করতে করতে ছুটবে । সন্দীপের এই কথা আমার মনের মধ্যে যেন ডমরু বাজাতে থাকে। তাই আমার আপনার সঙ্গে যখন আপনার বিরোধ বাধে, যখন লজ্জা আমাকে ধিক্কার দিতে থাকে তখন সন্দীপের কথা আমার মনে আসে। তখন বুঝতে পারি আমার এ লজ্জা কেবল লোকলজ্জা—সে আমার মেজো জায়ের মূতি ধরে বাইরে বসে বসে স্বপুরি কাটতে কাটতে কটাক্ষপাত করছে । তাকে আমি কিসের গ্রাহ করি । “আমি চাই” এই কথাটাকেই নিঃসংকোচে অবাধে অন্তরে বাহিরে সমস্ত শক্তি দিয়ে বলতে পারাই হচ্ছে আপনার পূর্ণ প্রকাশ–না বলতে পারাই হচ্ছে ব্যর্থতা। কিসের ওই পরগাছা, কিসের ওই কুলুঙ্গি—আমার এই উদ্দীপ্ত-আমিকে ব্যঙ্গ করে অপমান করে এমন সাধ্য ওদের কী আছে । এই বলে তখনই ইচ্ছে হল, ওই পরগাছাটাকে জানলার বাইরে ফেলে দিই— ছবিটাকে কুলুঙ্গি থেকে নামিয়ে আনি—প্ৰলয়শক্তির লজ্জাহীন উলঙ্গতা প্রকাশ হ’ক । হাত উঠেছিল, কিন্তু বুকের মধ্যে বিধল, চোখে জল এল—মেজের উপর উপুড় হয়ে পড়ে কাদতে লাগলুম। কী হবে, আমার কী হবে । আমার কপালে কী আছে !