পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ミ.)○ নিখিল বললে, উপায় নেই। প্রাণটা কলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই বলে প্রাণটাকে কল বলে সোজা করে জানলেই যে প্রাণটাকে জানা হয় তা নয় । তেমনি আত্মা ফলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই আত্মাকে ফলের মধ্যে চরম করে দেখাই যে আত্মাকে সত্য দেখা তা বলব না । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তবে তুমি কোথায় আত্মাকে দেখছ ? কোন নাকের ডগায়, কোন ভ্রর মাঝখানে ? সে বললে, আত্মা যেখানে আপনাকে অসীম জানছে, যেখানে ফলকে ছেড়ে এবং ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে । তাহলে নিজের দেশ সম্বন্ধে কী বলবে ? ওই একই কথা । দেশ যেখানে বলে, আমি আমাকেই লক্ষ্য করব, সেখানে সে ফল পেতে পারে কিন্তু আত্মাকে হারায়—যেখানে সকলের চেয়ে বড়োকে সকলের বড়ো করে দেখে, সেখানে সকল ফলকেই সে খোয়াতে পারে কিন্তু আপনাকে সে পায় । ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত কোথায় দেখেছ ? মানুষ এতবড়ো যে, সে যেমন ফলকে অবজ্ঞা করতে পারে তেমনি দৃষ্টাস্তকেও ৷ দৃষ্টাস্ত হয়তো নেই—বীজের ভিতরে ফুলের দৃষ্টাস্ত যেমন নেই ; কিন্তু বীজের ভিতরে ফুলের বেদনা আছে। তবু, দৃষ্টাস্ত কি একেবারেই নেই ? বুদ্ধ বহু শতাব্দী ধরে যে-সাধনায় সমস্ত ভারতবর্ষকে জাগিয়ে রেখেছিলেন, সে কি ফলের সাধনা ? নিখিলের কথা আমি যে একেবারেই বুঝতে পারি নে তা নয় । কিন্তু সেইটিই হল আমার মুশকিল। ভারতবর্ষে আমার জন্ম—সাত্ত্বিকতার বিষ রক্তের মধ্যে থেকে একেবারে মরতে চায় না। আপনাকে বঞ্চিত করার পথে চলা যে পাগলামি এ-কথা মুখে যতই বলি এটাকে একেবারে উড়িয়ে দেবার সাধ্য নেই। এইজন্তেই আমাদের দেশে আজকাল অস্তৃত ব্যাপার চলছে। ধর্মের ধুয়ো দেশের ধুয়ো দুটিকেই পুরোদমে একসঙ্গে চালাচ্ছি—ভগবদগীতা এবং বন্দেমাতরং আমাদের দুইই চাই—তাতে ছুটোর কোনোটাই যে স্পষ্ট হতে পারছে না, তাতে একসঙ্গেই গড়ের বাস্ত এবং সানাই বাজানো চলছে, এ আমরা বুঝছি নে। আমার জীবনের কাজ হচ্ছে এই বেস্বরে গোলমালটাকে থামানো, আমি গড়ের বাদ্যটাকেই বাহাল রাখব—সানাই আমাদের সর্বনাশ করেছে। প্রবৃত্তির যে জয়পতাকা আমাদের হাতে দিয়ে মা প্রকৃতি, মা শক্তি, মা মহামায়া রণক্ষেত্রে আমাদের পাঠিয়েছেন তাকে আমরা লজ্জা দেব না। প্রবৃত্তিই সুন্দর, প্রবৃত্তিই নির্মল, যেমন নির্মল ভু"ইচাপা ফুল, ষে কথায় কথায় স্বানের ঘরে ভিনোলিয়া সাবান মাখতে ছোটে না ।