পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२० রবীন্দ্র-রচনাবলী হল ? একটা মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জেনেছি তাই বলে জীবনের সমস্ত সত্য অজ উজাড় হয়ে গেল ? শোবার ঘরের শেলফ থেকে একটা বই আনতে আজ সকালে গিয়েছিলুম। কতদিন দিনের বেলায় আমার শোবার ঘরে আমি ঢুকি নি। আজ দিনের আলোতে ঘরের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল! সেই আনলাটিতে বিমলের কেঁচানো শাড়ি পাকানো রয়েছে, এক কোণে তার ছাড়া শেমিজ আর জামা ধোবার জন্তে অপেক্ষা করছে। আয়নার টেবিলের উপর তার চুলের কাটা, মাথার তেল, চিরুনি, এসেন্সের শিশি, সেই সঙ্গে সি দুরের কৌটোটিও ! টেবিলের নিচে তার ছোট্ট সেই একজোড়া জরিদেওয়া চটিজুতো,—একদিন যখন বিমল কোনোমতেই জুতো পরতে চাইত না সেই সময়ে আমি ওর জন্যে আমার এক লক্ষেীয়ের সহপাঠী মুসলমান বন্ধুর যোগে এই জুতো আনিয়ে দিয়েছিলুম। কেবলমাত্র শোবার ঘর থেকে আর ওই বারান্দা পর্যন্ত এই জুতো পরে যেতে সে লজ্জায় মরে গিয়েছিল । তার পরে বিমল অনেক জুতো ক্ষয় করেছে কিন্তু এই চটিজোড়াটি সে আদর করে রেখে দিয়েছে । আমি তাকে ঠাট্ট করে বলেছিলুম, যখন ঘুমিয়ে থাকি লুকিয়ে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে তুমি আমার পুজো কর—আমি তোমার পায়ের ধুলো নিবারণ করে আজ আমার এই জাগ্রত দেবতার পুজো করতে এসেছি । বিমল বললে, ধাও তুমি অমন করে ব’লো না তাহলে ককখনো ও-জুতো পরব না -এই আমার চির-পরিচিত শোবার ঘর—এর একটি গন্ধ আছে যা আমার সমস্ত হৃদয় জানে —আর বোধ হয় কেউ তা পায় না । এই সমস্ত অতি ছোটো ছোটো জিনিসের মধ্যে আমার রসপিপাসু হৃদয় তার কত যে সূক্ষ্ম সুক্ষ্ম শিকড় মেলে রয়েছে তা আজ যেমন করে অনুভব করলুম তেমন আর কোনোদিন করি নি। কেবল মূল শিকড়টি কাটা পড়লেই যে প্রাণ ছুটি পায় তা তো নয়, ওই চটিজোড়াটা পর্যস্ত তাকে টেনে ধরতে চায় । সেই জন্যই তো লক্ষ্মী ত্যাগ করলেও তার ছিন্নপদ্মের পাপড়িগুলোর চারিদিকে মন এমন করে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় –দেখতে দেখতে হঠাৎ কুলুঙ্গিটার উপর চোখ পড়ল। দেখি আমার সেই ছবি তেমনিই রয়েছে, তার সামনে অনেক দিনের শুকনো কালো ফুল পড়ে আছে। এমনতরো পূজার বিকারেও ছবির মুখে কোনো বিকার নেই। এ ঘর থেকে এই শুকিয়ে-যাওয়া কালো ফুলই আজ আমার সত্য উপহার ! এরা যে এখনো এখানে আছে তার কারণ এদের ফেলে দেওয়ারও দরকার নেই । যাই হ’ক, সত্যকে আমি তার এই নীরস কালো মূর্তিতেই গ্রহণ করলুম—কবে সেই কুলুঙ্গির ভিতরকার ছবিটারই মতো নির্বিকার হতে পারব ?