পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२२२ রবীন্দ্র-রচনাবলী আয়না চিরুনি প্রভৃতি চাষার মেয়েদের লোভনীয় জিনিস নিয়ে হাটু-জল ভেঙে বিল পেরিয়ে সে নমঃশূদ্ৰদের পাড়ায় যায় ; সেখানে এই জিনিসগুলোর বদলে মেয়েদের কাছ থেকে ধান পায় । তাতে পয়সার চেয়ে কিছু বেশি পেয়ে থাকে। যেদিন সকাল সকাল ফিরতে পারে সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাতাসাওয়ালার দোকানে বাতাসা কাটতে যায় । সেখান থেকে ফিরে বাড়ি এসে শাখা তৈরি করতে বসে— তাতে প্রায় রাত দুপুর হয়ে যায় । এমন বিষম পরিশ্রম করেও বছরের মধ্যে কেবল কয়েক মাস ছেলেপুলে নিয়ে দু-বেলা দু-মুঠো খাওয়া চলে। তার আহারের নিয়ম এই যে, খেতে বসেই সে একঘাট জল খেয়ে পেট ভরায়, আর তার খাদ্যের মস্ত একটা ংশ হচ্ছে সস্তা দামের বীজে-কলা । বছরে অন্তত চার মাস তার একবেলার বেশি খাওয়া জোটে না । আমি এক সময়ে একে কিছু দান করতে চেয়েছিলুম। মাস্টারমশায় আমাকে বললেন, তোমার দানের দ্বারা মানুষকে তুমি নষ্ট করতে পার, দুঃখ নষ্ট করতে পার না । আমাদের বাংলা দেশে পঞ্চু তো একলা নয়। সমস্ত দেশের স্তনে আজ দুধ শুকিয়ে এসেছে। সেই মাতার দুধ তুমি তো অমন করে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে জোগাতে পারবে না । এই সব কথা ভাববার কথা। স্থির করেছিলুম এই ভাবনাতেই প্রাণ দেব। সেদিন বিমলাকে এসে বললুম, বিমল, আমাদের দুজনের জীবন দেশের দুঃখের মূল ছেদনের কাজে লাগাব ! டி বিমল হেসে বললে, তুমি দেখছি আমার রাজপুত্র সিদ্ধার্থ, দেখো শেষে আমাকে ভাসিয়ে চলে যেয়ে না । - আমি বললুম, সিদ্ধার্থের তপস্তায় তার স্ত্রী ছিলেন না, আমার তপস্তায় স্ত্রীকে চাই। এমনি করে কথাটা হাসির উপর দিয়েই গেল । আসলে বিমল স্বভাবত, যাকে বলে মহিলা । ও যদিও গরিবের ঘর থেকে এসেছে কিন্তু ও রানী I ও জানে, যারা নিচের শ্রেণীর, তাদের স্থখদুঃখ-ভালোমন্দর মাপকাঠি চিরকালের জন্যই নিচের দরের ৷ তাদের তো অভাব থাকবেই কিন্তু সে-অভাব তাদের পক্ষে অভাবই নয় । তারা আপনার হীনতার বেড়ার দ্বারাই স্বরক্ষিত। যেমন ছোটো পুকুরের জল আপনার পাড়ির বাধনেই টিকে থাকে। পাড়িকে কেটে বড়ো করতে গেলেই তার জল ফুরিয়ে পাক বেরিয়ে পড়ে। যে আভিজাত্যের অভিমানে খুব ছোটো ছোটো ভাগের মধ্যে ভারতবর্ষ খুব ছোটো ছোটো গৌরবের আসন ঘের দিয়ে রেখেছে, যাতে করে ছোটো ভাগের হীনতার গণ্ডির মধ্যেও নিজের মাপ-অনুযায়ী একটা কৌলীন্ত