পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে Se) এবং স্বাতন্ত্র্যের গর্ব স্থান পায়, বিমলের রক্তে সেই অভিমান প্রবল। সে ভগবান মন্থর দৌহিত্রী বটে। আমার মধ্যে বোধ হয় গুহক এবং একলব্যের রক্তের ধারাটাই প্রবল ; আজ যারা আমার নিচে রয়েছে তাদের নীচ বলে আমার থেকে একেবারে দূরে ঠেলে রেখে দিতে পারি নে। আমার ভারতবর্ষ কেবল ভদ্রলোকেরই ভারতবর্ষ নয় । আমি স্পষ্টই জানি আমার নিচের লোক যত নাবছে ভারতবর্ষই নাবছে, তারা যত মরছে ভারতবর্ষই মরছে। বিমলকে আমার সাধনার মধ্যে পাই নি । আমার জীবনে আমি বিমলকে এতই প্রকাও করে তুলেছি যে, তাকে না পাওয়াতে আমার সাধনা ছোটাে হয়ে গেছে । আমার জীবনের লক্ষ্যকে কোণে সরিয়ে দিয়েছি বিমলকে জায়গা দিতে হবে বলে । তাতে করে হয়েছে এই যে, তাকেই দিনরাত সাজিয়েছি পরিয়েছি শিখিয়েছি, তাকেই চিরদিন প্রদক্ষিণ করেছি—মানুষ যে কত বড়ো, জীবন যে কত মহৎ সে-কথা স্পষ্ট করে মনে রাখতে পারি নি । তবু এর ভিতরেও আমাকে রক্ষা করেছেন আমার মাস্টারমশায়—তিনিই আমাকে যতটা পেরেছেন বড়োর দিকে বাচিয়ে রেখেছেন, নইলে আজকের দিনে আমি সর্বনাশের মধ্যে তলিয়ে যেভূম। আশ্চর্য ওই মানুষটি। আমি ওঁকে আশ্চর্য বলছি এই জন্তে যে আজকের আমার এই দেশের সঙ্গে কালের সঙ্গে ওঁর এমন একটা প্রবল পার্থক্য আছে। উনি আপনার অন্তর্যামীকে দেখতে পেয়েছেন সেইজন্তে আর কিছুতে ওঁকে ভোলাতে পারে না। আজ যখন আমার জীবনের দেনাপাওনার হিসাব করি তখন একদিকে একটা মস্ত ঠিকে-ভূল, একটা বড়ো লোকসান ধরা পড়ে, কিন্তু লোকসান ছাড়িয়ে উঠতে পারে এমন একটি লাভের অঙ্ক আমার জীবনে আছে সে-কথা যেন জোর করে বলতে পারি। আমাকে যখন উনি পড়ানো শেষ করেছেন তার পূর্বেই পিতৃবিয়োগ হয়ে আমি স্বাধীন হয়েছি। আমি মাস্টারমশায়কে বললুম, আপনি আমার কাছেই থাকুন, অন্ত জায়গায় কাজ করবেন না । তিনি বললেন, দেখো, তোমাকে আমি যা দিয়েছি তার দাম পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি যা দিয়েছি তার দাম যদি নিই তাহলে আমার ভগবানকে হাটে বিক্রি করা হবে। বরাবর তার বাসা থেকে রৌদ্রবৃষ্টি মাথায় করে চন্দ্রনাথবাবু আমাকে পড়াতে এসেছেন, কোনোমতেই আমাদের গাড়িঘোড়া তাকে ব্যবহার করাতে পারলুম না। তিনি বলতেন, আমার বাবা চিরকাল বটতলা থেকে লালদিঘি পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে