পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ミ○8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিখিলেশের আত্মকথা পষ্ণুর স্ত্রী যক্ষ্মায় ভুগে ভুগে মরেছে। পঞ্চুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে । সমাজ হিসেব করে বলেছে, খরচ লাগবে সাড়ে তেইশ টাকা । আমি রাগ করে বললুম, নাই বা করলি প্রায়শ্চিত্ত, তোর ভয় কিসের ? সে ক্লাস্ত গোরুর মতো তার ধৈর্ধভারপূর্ণ চোখ তুলে বললে, মেয়েটি আছে বিয়ে দিতে হবে। আর, বউয়েরও তো গতি করা চাই । আমি বললুম, পাপই যদি হয়ে থাকে, এতদিন ধরে তার প্রায়শ্চিত্ত তো কম হয় নি । সে বললে, আজ্ঞে কম কী । ডাক্তার-খরচায় জমিজমা কিছু বিক্রি আর বাকি সমস্ত বন্ধক পড়ে গেছে। কিন্তু দান-দক্ষিনে ব্রাহ্মণ-ভোজন না হলে তো থালাস পাই নে । তর্ক করে কী হবে ? মনে মনে বললুম, যে-ব্রাহ্মণ ভোজন করে, তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কবে হবে ? একে তো পঞ্চু বরাবরই উপবাসের ধার ঘেঁষে কাটিয়েছে, তার উপরে এই স্ত্রীর চিকিৎসা এবং সংকার উপলক্ষে সে একেবারে অগাধ জলে পড়ল । এই সময়ে কোনোরকম করে একট। সাস্বনা পাবার জন্তে সে এক সন্ন্যাসী সাধুর চেলাগিরি শুরু করলে। তাতে হল এই, তার ছেলেমেয়েরা যে খেতে পাচ্ছে না সেইটে ভুলে থাকবার একট। নেশায় সে ডুবে রইল। বুঝে নিলে সংসারটা কিছুই না—মুথ যেমন নেই তেমনি দুঃখটাও স্বপ্নমাত্র । অবশেষে একদিন রাত্রে ছেলেমেয়ে চারটিকে ভাঙা ঘরে ফেলে রেখে সে বৈরাগী হয়ে বেরিয়ে চলে গেল । এ-সব কথা আমি কিছুই জানতুম না। আমার মনটার মধ্যে তপন স্বরামুরের মন্থন চলছিল। মাস্টারমশায় যে পঞ্চুর ছেলেমেয়েগুলিকে নিজের বাসায় রেখে মানুষ করছেন সে-কথাও আমাকে জানান নি। তখন তার নিজের ছেলে তার বউকে নিয়ে রেজুন চলে গেছে ; ঘরে তিনি একলা, তার আবার সমস্ত দিন ইস্কুল । এমনি করে এক মাস যখন কেটে গেছে তখন একদিন সকালবেলায় পঞ্চু এসে উপস্থিত । তার বৈরাগ্যের ঘোর ভেঙেছে। যখন তার বড়ো ছেলেমেয়ে দুটি তার কোলের কাছে মাটির উপর বসে তাকে জিজ্ঞাসা করলে, বাৰা তুই কোথায় গিয়েছিলি, সব-ছোটো ছেলেটি তার কোল দখল করে বসলে, আর সেজো মেয়েটি পিঠের উপর পড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলে, তখন কান্নার পর কান্না, কিছুতে তার কান্না থামতে